পাঠকের পছন্দ

Tuesday, September 22, 2015

কথা কলকাতা - চার

কথা কলকাতা - ৪

ঊনিশ শতকের ‘নগর কলকাতা’ । জন্মের একশো বছর পেরিয়ে সামান্য হলেও শিক্ষার আলোকরেখা দেখতে পেয়েছে । এসে গেছে সংবাদ পত্র । ইংরেজ তার সাম্রাজ্য শাসনের স্বার্থে বাংলা বই লেখানো শুরু করলো । স্রীরামপুর থেকে ফোর্ট  উইলিয়ামে যোগ দিলেন পাদরি উইলিয়াম কেরি । ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা শেখানোর বই লেখার জন্য সাহায্য নিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের । কেরি সাহেব তাঁর মুন্সি রামরাম বসুকে দিয়ে লেখালেন ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’, গোলকনাথ শর্মা সংস্কৃত থেকে বাংলায় লিখলেন ‘হিতোপদেশ’, পন্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার লিখলেন ‘বত্রিশ সিংহাসন’ ও ‘রাজাবলী’ । সূচনা হল বাংলা গদ্য রচনার ধারাবাহিকতা ।

কলকাতার সমাজ তখন এক কদর্য বিলাসিতা আর বেলেল্লাপনার প্রতিভু । সারা বাংলার কৃষককে নিঃস্ব করে বেড়ে উঠলো নগর কলকাতার জৌলুশ । ব্রিটিশরা জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতো । আর কলকাতায় থাকা জমিদার তার নায়েব, গোমস্তা, তালুকদার মারফৎ দরিদ্র কৃষকের কাছ থেকে তার বহুগুন বেশি আদায় করতো । ফলে বাংলার কৃষক নিঃস্ব ক্ষেতমজুরে পরিনত হল। জমির ওপর তার কোন অধিকার থাকলো না । তার জন্ম ঋণের মধ্যে, জীবন যাপন ঋণের বোঝা নিয়ে, তার মৃত্যুও ঋণের মধ্যে । অঠেরো শতকটা ছিল বেনিয়া, মুৎসুদ্দিদের যুগ আর উনিশ শতকে দেখা দিল জমিদার শ্রেণীর প্রাধান্য । ইংরাজ কোম্পানির সঙ্গে বেনিয়া, মুৎসুদ্দিগিরি, ব্যবসা করে যে বাঙ্গালিরা প্রভুত ধন সঞ্চয় করেছিল তারা ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে সেই অর্থে জমিমিদারি কিনে কলকাতায় অলস, বিলাসী জীবনে ভাসলো আর কলকাতার জৌলুশে আকর্ষিত হয়ে মারোয়াড়ি, গুজরাতি ব্যবসায়ীদের কলকাতায় আগমন শুরু হ’ল ।  বড় লাটের থাকার জন্য লাটভবন তৈরী হল ১৮০৪এ ১৩ লক্ষ টাকা ব্যয় করে । ১৮১৩তে টাউন হল তৈরী হ’ল ৭ লক্ষ টাকা খরচ করে । সারা বাংলার লুন্ঠিত সম্পদে কলকাতার জৌলুশ বাড়তে থাকলো । ক্লাইভ প্রথম মুর্শিদাবাদ শহর দেখে বলেছিল লন্ডন শহর মুর্শিদাবাদের ধারে কাছে আসতে পারবে না । সেই মুর্শিদাবাদ তার পুরানো গৌরব হারাল, জলকাতার চেয়ে অনেক পুরাতন ও সমৃদ্ধশালী শহর ঢাকা হয়ে গেল উপেক্ষিত মফঃস্বল, ‘নগর কলকাতা’ হয়ে উঠলো বাংলার এক ও অদ্বিতীয় শহর । ১৮১৩তে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বানিজ্যের অধিকার রদ করা হল, শুরু হ’ল  কলকাতায় অন্য ইউরোপীয় বানিজ্য প্রতিষ্ঠানের আগমন ।

কলকাতার রাস্তাঘাট, শহর উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য ইংরেজরা লটারি করে টাকা তোলার বন্দোবস্ত করেছিল । লটারির টাকাতেই টাউন হল তৈরী হয়েছিল । ১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ পর্যন্ত ২০ বছর এই লটারি কমিটি কাজ করার পর ইংলন্ডের কর্তাদের বোধদয় হয় যে, শহর উন্নয়নের জন্য লটারি করে টাকা তোলা গর্হিত কাজ । লটারি কমিটি বন্ধ হয়ে যায় । ১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ পর্যন্ত লটারি কমিটি কলকাতায় যে রাস্তাগুলি তৈরী করেছিল সেগুলি হ’ল – ইলিয়ট রোড, স্ট্র্যান্ড রোড (প্রিন্সেপ ঘাট থেকে হাটখোলা পর্যন্ত),উড স্ট্রীট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট, কর্নোয়ালিশ স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট,ওয়েলিংডন স্ট্রীট, হেস্টিংস স্ট্রীট, ময়রা স্ট্রীট,লাউডন স্ট্রীট, আমহার্স্ট স্ট্রীট, হেয়ার স্ট্রীট, কলুটোলা স্ট্রীট, মির্জাপুর স্ট্রীট, ক্যানাল স্ট্রীট, হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রীট ও রডন স্ট্রীট ।

লটারি কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল কলকাতার রাস্তা তৈরী করতে প্রত্যেক বছরে প্রয়োজন ১২০লক্ষ ইটের । ইট ভাঙ্গা খোয়া দিয়েই রাস্তা পাকা করা হ’ত । খোয়া ভাঙ্গার খরচ চিল ৮০ লক্ষ ইটের জন্য ৪৪৪৫টাকা । সেই সময় একজন মজুর ৩৬০০ ইট ভেঙ্গে খোয়া তৈরী করার মজুরি পেত ২টাকা মাত্র । অন্যদিকে কলকাতার বাবুরা লাখলাখ টাকা ওড়াত বাইজী নাচ, রক্ষিতা আর গণিকা পোষার পেছনে । কি হৃদয়হীন বৈপরীত্য ! ১৯২৪সাল পর্যন্ত খোয়ার রাস্তাই ছিল কলকাতার পাকা রাস্তা । পিচের রাস্তা করা শুরু হয়েছে ‘নগর কলকাতা’র জন্মের সোয়া দুশো বছর পর ১৯২৪ থেকে ।

১৮১৫তে তাঁর ৪২ বছর বয়সে স্থায়ি ভাবে বাস করতে কলকাতায় এলেন রামমোহন রায় – ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ । প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আত্মীয় সভা’ মাণিকতলা উদ্যান গৃহে । ইতিমধ্যে ১৮০০ সনে এক জনকল্যানকামী ও শিক্ষানুরাগী স্কটিশ ডেভিড হেয়ার ভারতে এসেছেন । এসেছিলেন সামান্য এক ঘড়ি নির্মাণ ব্যবসায়ী হয়ে । দেশীয় মানুষের অশিক্ষা আর নানান দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করে তাঁর মানসিক পরিবর্তন হয়েছিল, যোগাযোগ হয় রামমোহন রায়ের সঙ্গে । রামমোহন রায় ও রাধাকান্ত দেবের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দু কলেজ ২০শে জানুয়ারি ১৮১৭তে (এখন যা ‘প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে বিশ্বখ্যাত) । ঐ বছরেই তাঁর উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি এবং পরের বছর ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ । আরো কয়েকটি স্কুল ও একটি দেশীয় মেয়েদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন এই মহান শিক্ষাব্রতী । হিন্দু কলেজ ও ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার ফলে এক আধুনিক যুগের সূচনা হ’ল, কলকাতার সমাজে দেখা দিল নতুন জাগরণ । ডেভিড হেয়ার ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন না এই অভিযোগে খৃষ্টান মিশনারিদের কবরখানায় তাঁর মৃতদেহ যায়গা পায়নি । হেয়ারকে সমাধিস্থ করা হয় হেয়ার স্কুলের জন্য দেওয়া তাঁরই জমিতে ।

রক্ষণশীল হিন্দুদের প্রবল বাধা, এমনকি দৈহিক আক্রমণকে অগ্রাহ্য করে রামমোহন শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে ও সামাজিক কূপ্রথার বিরুদ্ধে জনচেতনা জাগ্রত করতে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন । ওদিকে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করলেন ‘সমাচার দর্পণ’ ১৮১৮তে, যে পত্রিকার কথা েই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি । কলকাতায় অতয়েব বাংলা সংবাদপত্রে ঢেউ পৌছে গেল । রামমোহন রায় বের করলেন বাংলা সংবাদ পত্র ‘সম্বাদ কৌমুদি’(১৮২১) ও ফারসি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল–আখবর’(১৮২২) । দেশীয় সংবাদ পত্রের প্রসারে প্রমাদ গুনল ইংরেজ শাসন । তারা দেশীয়ভাষায় সংবাদ প্রকাশের পাঁচ বছরের মধ্যেই জারি করে দিল ‘ভার্নাকুলার প্রেস এক্ট’ বা ‘দেশীয় সংবাদ পত্র নিয়ন্ত্রণ আইন’ ১৮২৩এ । সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে রামমোহন কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সহ প্রতিবাদ পত্র পাঠালেন বৃটেনের রাজার কাছে । প্রতিবাদ পত্রে রামমোহন বৃটিশ সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন েই বলে ‘পৃথিবীর কোথাও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য বিপ্লব ঘটেনি । বরং সংবাদপত্র দমন করলেই দেখা দিয়েছে বিক্ষোভ ও রাষ্ট্র বিপ্লব’ । ইংরাজ শাসনের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে কলকাতা সেই প্রথম প্রতিবাদী কন্ঠ শুনলো রামমোহনের মধ্যে । ইংলন্ডের রাজা রামমোহনের আর্জিতে কর্ণপাত করেনি । প্রতিবাদে রামমোহন তাঁর ফার্সি ভাষার সংবাদপত্র মিরাৎ-উল আখবর’এর প্রকাশ বন্ধ করে দিলেন । সংবাদপত্রটির শেষ সংখ্যায় রামমোহন একটি ফার্সি বয়াৎ ছাপালেন বাংলায় যার অর্থ “যে সম্মান হৃদয়ের শত রক্তবিন্দুর বিনিময়ে কেনা, হে মহাশয়, কোন অনুগ্রহের আশায় তাকে দারোয়ানের কাছে বিক্রি করো না” । চার্লস মেটকাফে অস্থায়ী বড়লাট হয়ে এসে ‘দেশীয় সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন’ রদ করেন ১৮৩৫এর অগস্টে । রামমোন তা দেখে যেতে পারেননি । ১৮৩৩এ লন্ডনে তাঁর মৃত্যু হয় । কিন্তু একটা চেতনাহীন সমাজে অশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের অচলায়তনে ভিতটা নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন মাত্র পনেরো বছরের কলকাতা বাসের জীবনে, পরের প্রজন্ম তাঁর দেখানো পথেই অগ্রসর হবে, এটা স্থির হয়ে গেল ।

রামমোহন রায় কলকাতায় স্থায়ী ভাবে আসার আগে কলকাতার এন্টালির পদ্মপুকুর অঞ্চলের এক অ্যালো ইন্ডিয়ান পরিবারে  জন্মগ্রহণ করল এক শিশু । হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও । কলকাতার তরুণ প্রজন্ম তখন হাজার বছরের চেতনাহীন সমাজে মুক্ত চিন্তার আলোকরেখার সন্ধান পেয়েছে । সতেরো বছর বয়সে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে ইংরাজি সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক রূপে যোগ দিলেন । মাত্র ২০জন ছাত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠা ১৮১৭সালে হয়েছিল হিন্দু কলেজের, ডিরোজিওর শিক্ষকতাকালে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে হ’ল ৪০২জন । ডিরোজিওর ছাত্ররা পুরাতন সংস্কার, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস বিসর্জন দিয়ে জ্ঞানের আলোতে বুদ্ধির মুক্তি আর চিন্তার স্বাধীনতায় তখন তারা উদ্ভাসিত । নতুন চিন্তার হাওয়া বইতে লাগল নগর কলকাতায় ।




No comments:

Post a Comment