পাঠকের পছন্দ

Tuesday, September 22, 2015

কথা কলকাতা - পাঁচ

কথা কলকাতা – ৫

কলকাতার নগরায়ন স্বাভাবিক পথে হয়নি । ইংরেজ তার বণিকি স্বার্থে পরিকল্পনাহীন ভাবে নগর কলকাতার পত্তন ঘটিয়েছিল আর তাকে ঘিরে  গড়ে উঠেছিল ইংরাজের দালালি করা এক লোভি, দূর্নীতি পরায়ন, অলস নাগরিক সমাজ । আঠেরো শতকের কলকাতা ছিল এদেশীয় দালাল, মুৎসুদ্দি , বেনিয়াদের কলকাতা আর উনিশ শতকে ‘বাবু’ কলকাতা । আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কলকাতার সেই বাবুসমাজের বর্ণনা দিয়েছেন এইরকম – “ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিছু বর্ণনা করিব ? মুখে,ভ্রুপার্শে ও নেত্রকোণে নৈশ অত্যাচারের চিহ্ন স্বরূপ কালিমারেখা  । শিরে তরঙ্গায়িত বাবরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে কালোপেড়ে ধুতি । অঙ্গে উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান,গলদেশে উত্তমরূপে চুনোট করা উড়া্নী এবং পায়ে পুরু বাগলস সমন্বিত চিনাবাড়ির জুতা । এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া বুলবুলের লড়াই দেখিয়া,সেতার, েসরাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, আফ আখরাই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের মেলা, মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময় কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিয়া থাকিত” ।

কিন্তু উনিশ শতকের এই ভ্রষ্টাচারী ‘বাবু’ শ্রেণীটাই কলকাতার আসল প্রতিনিধি ছিল না । রামমোহন ও ডিরোজিওর সমাজভাবনা ও মুক্তচিন্তার প্রভাবে যে নতুন আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল তারাই স্বাদেশিকতার আলো জ্বালিয়েছিলেন । ভারতবর্ষকে মাতৃভূমি রূপে কল্পনা করে প্রথম কবিতা লেখেন ডিরোজিও । তথাপি স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে সামগ্রিক ভাবে বাংলার কৃষক বা শ্রমজীবি মানুষের দুঃখ-দূর্দশা সম্পর্কে তাঁরা উদাসিনই ছিলেন । এই আলোকপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটির লক্ষ্য ছিল ইংরেজের সঙ্গে একত্রে প্রশাসনের ভাগীদার হয়ে তাদের সমান মর্যাদা অর্জন করা ।

ছাপাখানার আবির্ভাব কলকাতার নবীন প্রজন্মের মানসিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল । ১৮২৫-২৬ সালের মধ্যে কলকাতায় কুড়িটিরও বেশি ছাপাখানা বসে  গিয়েছিল । ইংরেজরা তাদের শাসনের কাজের জন্য কলকাতায় ছাপাখানা এনেছিল, এটা একটা ঘটনা মাত্র কিন্তু ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা ও ব্যবহারে এদেশীয়রা অনেক বেশি আগ্রহী ও তৎপর ছিল । উনিশ শতকে বাংলায় বুদ্ধির জাগরণে মুদ্রন যন্ত্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয় । বাংলার বুদ্ধির জাগরণে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুররা অগ্রপথিক, কিন্তু এদের সঙ্গে দুটি নাম নিশ্চিত ভাবেই সমান শদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় তাঁরা হলেন ত্রিবেণীর এক কর্মকার পঞ্চানন এবং শ্রীরামপুরের বহরা গ্রামের এক বাঙালি ব্রাহ্মণ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য । পঞ্চানন কর্মকার প্রথম বাংলা হরফ তৈরী করেন ১৭৮৪ সনে । আর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন । গঙ্গাকিশোর শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিষ্ট মিশনের ছাপাখানায় কম্পোজিটর ছিলেন, তারপর কলকাতায় । গঙ্গাকিশোরই কলকাতায় প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন । ১৮১৬তে প্রকাশিত ভরতচন্দ্রের ‘অন্দদামঙ্গল’ কলকাতায় ছাপা প্রথম সচিত্র বাংলা বই । বইটির কাটতি বাড়ানোর জন্য গঙ্গাকিশোর একটি দোকান খোলেন । সুতরাং গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই নগর কলকাতায় প্রথম বইএর দোকান খোলার পথ দেখিয়েছিলেন । ১৮১৮তে গঙ্গাকিশোর নিজেই একটি ছাপাখানা বসান এবং সেখান থেকে ‘বেঙ্গল গেজেটি’ নামে বাংলা সাময়িক পত্রের প্রকাশ শুরু করেন । সেটিই  বাঙালি প্রবর্তিত প্রথম সংবাদ পত্র । কলকাতা যে একদিন ‘গ্রন্থনগরী’তে পরিণত হ’ল তার আদি কারিগর গ্রামীণ বাংলা থেকে উঠে আসা এই দুজন – পঞ্চানন কর্মকার ও গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও আরো কয়েকজন । তখন রেলগাড়ি আসেনি, ডাক ব্যবস্থা শুরু হয়নি, কারখানার ভোঁ বাজতো না । তখন এরাই হয়েছিলেন কলকাতার সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রথম নেপথ্য পুরোহিত ।

১৮৩০এ কলকাতা তখনও প্রাসাদ নগরী হয়ে ওঠেনি । কিন্তু গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠার সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল । ১৮৩০এর ২৩শে অক্টোবর ‘সমাচার দর্পন’পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “কিন্তু দশ দশবৎসরাবধি ভারতবর্ষে মুদ্রাঙ্কনকার্য্যের অপূর্বরূপ বৃদ্ধি হইয়াছে এবং কলিকাতা নগরে ভুরিভুরি ঐ যন্ত্রালয় হইয়াছে । তদধক্ষ্যেরা এওক্ষণে প্রতিযোগিতারূপে এমত উদ্যোগ করিতেছেন যে কে কত উত্তমরূপে অথচ অল্পমূল্যে গ্রন্থাদি ছাপাইতে পারেন”। এই সময়ে অর্থাৎ রামমোহনের যুগেই কলকাতা থেকে ১৬টি ইংরাজি, ৪টি বাংলা ও ১টি ফারসি পত্রিকা প্রকাশিত হ’ত । মুদ্রন যন্ত্রের বিপুল প্রসার না ঘটলে এতগুলি পত্রিকার প্রকাশ সম্ভব হ’ত না । কলকাতায় প্রথম বাংলা বই ছাপা হয় ১৮১৬তে, আর ১৮২৯এর ‘সমাচার দর্পণ’ জানিয়েছিল যে ঐবছর মোট ৩৭টি বই ছাপা হয়েছিল ।

১৮৩৫এ ইংরাজরা প্রবর্তন করলেন একটি সাধারণ গ্রন্থাগার বা ‘পাবলিক লাইব্রেরী’ । এদেশীয় লোকেরাও পিছিয়ে রইলেন না , ১৮৩৯এর ফেব্রুয়ারিতে কিছু সদাশয় ধনী ব্যক্তির অর্থানুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত হল তাদের ‘সাধারণ গ্রন্থাগার’ । ঐবছর জুনের মধ্যেই সেই গ্রন্থাগারের পুস্তক সংখ্যা হয়েছিল ১৮হাজার ।
‘বটতলার সাহিত্য’ বলে একটা বিদ্রুপবাক্য আমাদের সাংস্কৃতিক মহলে খুব প্রচলিত । মোটা দাগের অ-পরিশীলিত বই-পত্র, পঞ্জিকাতেই যে বইপত্রের বিজ্ঞাপন থাকে । এই ‘বটতলা’র কোন ভৌগলিক সীমানা নেই । চিৎপুরের অলিগলি, গরাণহাটা, আহিরিটোলা, শোভাবাজারে ছাপাখানায় বাংলা বইএর মুদ্রন ও  বিপনন ব্যবস্থা প্রথম সুরু হয়েছিল বাংলা বই ছাপার সেই আদিপর্বে । ধর্মীয় বই এর সংখ্যাই বেশি থাকতো, তৎকালীন ‘বাবু কালচারে’র সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আদিরসাত্মক বই ছাপা হ’ত অনেক ।

রক্ষণশীল হিন্দুরা তখন ভাবতেও পারতনা যে ধর্মগ্রন্থ ছাপাখানার কাগজে ছাপা হয়ে ঘরে ঘরে পৌছাবে । কারণটা সম্ভবত এই ছিল যে ছাপার কাগজ বানাত অন্যধর্মের লোকেরা, কম্পোজিটর বা মেসিন চালানোর লোকেরা ব্রাহ্মণ ছিল না । ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বটতলারই প্রকাশক ছিলেন । ভবানী চরণ শ্রীমদভাগবত ছেপেছিলেন বিশুদ্ধ হিন্দু মতে, ব্রাহ্মণ কম্পোজিটর দিয়ে অক্ষর সাজিয়ে, গঙ্গাজল দিয়ে কালি বানিয়ে পুঁথির আকারে বইটি ছেপে ছিলেন । দাম ছিল ৪০টাকা । ছাপা বইএর আদি যুগে বইএর দাম একটু বেশি ছিল,কিন্তু পরের ২৫/৩০ বছরে বটতলার প্রকাশকরা বইএর দাম অনেক কমিয়ে দেয় প্রতিযোগিতার কারণে । যেমন মুকুন্দরামের ‘চন্ডীমঙ্গল কাব্য’ ১৮২৩এ প্রথম ছাপা হওয়ার সময় দাম ছিল ৬টাকা, ১৮৫৬ সালে ঐ বইই দ্বিতীয়বার ছাপার পর দাম হয় একটাকা মাত্র । কৃত্তিবাসী  রামায়ণের আদিপর্ব ১৮৩১এ ছাপার সময় দাম ছিল দুটাকা আর ১৮৫৬ সালে ছাপার সময় দাম হয় দু আনা । উনিশ শতকে বাংলার বুদ্ধির জাগরণে অসামান্য অবদান ছিল কলকাতার ছাপাখানা আর বটতলার গ্রন্থপ্রকাশ । তখনও আধুনিক সভ্যজীবনের প্রায় কিছুই ছিল না কলকাতায়, কিন্তু ছাপাখানা ছিল, বই ছিল । ১৮৩০ সাল – রামমোহন রায় তখও জীবিত আর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন বীরসিংহ গ্রাম থেকে এসে কলকাতার বড়বাজারে রাইমণি দেবীর গৃহে দশ বছরের বালক ।


[ তথ্যসূত্র - ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’/বিনয় ঘোষ , রামমোহন ও ততকালীন সমাজ ও সাহিত্য/প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এবং ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা (১ম খন্ড) / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ]

No comments:

Post a Comment