সভ্যতার গর্ব করা ইংরাজ কোম্পানীর কর্মচারীদের দুর্নীতি আর তাদের দেশীয় সহযোগী বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের কৃতকর্মের কলঙ্কের কাদা সর্বাঙ্গে মেখে শুরু হয়েছিল নগর কলকাতার শৈশব । পলাশীর যুদ্ধজয় আর সিরাজদৌল্লাকে গুপ্ত হত্যার পর ক্লাইভরা মুর্শিদাবাদে নবাবের কোষাগার লুঠ করেছিল । কোষাগারে ছিল এক কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ রুপোর টাকা,বত্রিশ লক্ষ সোনার মোহর,দুই সিন্দুক ভর্তি সোনা,চার বাক্স হীরা জহরত, দুই বাকস চূণী পান্না এবং আরো অন্যান্য মূল্যবান রত্ন । ক্লাইভ নীজে লুঠের বখরা পেয়েছিল ২৩লক্ষ২৪হাজার টাকা । একশ নৌকা বোঝাই হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে লুঠের টাকা কলকাতায় আসে । সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ক্ষতিপুরনের এককোটি টাকা আসে ২৭টি নৌকা বোঝাই হয়ে । কোম্পানীর সহযোগী দেশীয় বেনিয়ারাও লুঠের বখরা পেয়েছিল । সেই সময়ে এই পরিমান অর্থের মূল্যমান কত ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায় । সেই সময় কুমারটুলি অঞ্চলে এককাঠা জমির দাম ছিল ১১টাকা ।
নবাবের কোষাগার
লুঠের টাকায় কলকাতার সমৃদ্ধির সূচনা হল । সমৃদ্ধি মানে ক্লাইভের মত অশিক্ষিত
অর্ধশিক্ষিত কোম্পানীর কর্মচারীরা আর তাদের দালাল বেনিয়ারা নবাব হয়ে গেল । ঘুষ, উতকোচ,
দূর্নীতি, বেলেল্লাপনার চূড়ান্তরূপ কলকাতা দেখেছিল তার শৈশবেই । সূচনা হল অর্থলোভী এক নতুন সমাজ – নতুন বণিক
সভ্যতা । শৈশবে পিতৃহীন নবকৃষ্ণ দেব ক্লাইভের সামান্য মুন্সী ছিলেন ।
সিরাজদৌল্লারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে মীরজাফর – ক্লাইভের বিশ্বস্ত সহযোগী হয়েছিলেন
। লুঠের মোটা বখরা পেলেন । নকৃষ্ণ হেস্টিংসকে ফার্সি, উর্দু ভাষা শেখাতেন ।
হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর সমস্ত সুতানুটির (এখনকার উত্তর কলকাতা)
তালুকদারী পেয়ে গেলেন নকৃষ্ণ । মুঘল বাদশাহর কাছ থেকে মহারাজা খেতাবও আনিয়ে দিলেন
হেস্টিংস । হঠাত ধনি এই দেশীয় বেনিয়া মুতসুদ্দিদের দ্বারা পরিপোষিত দূর্নীতি,
বেলেল্লাপনার বাবু সংস্কৃতির সেই শুরু । ১৭৭০এর মন্বন্তরে গোটা বাংলার একতৃতীয়াংশ
মানুষের মৃত্যুতেও কলকাতার এই নতুন নাগরিক সমাজের কোন হেলদোল হয় নি । শোনা যায়, নবকৃষ্ণ
দেব তার মায়ের শ্রাদ্ধতে দশ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন ।
মহারাজ নন্দকুমার
হেস্টিংসের দূর্নীতি, উৎকোচ নেওয়ার কথা জেনেছিলেন, অতয়েব মিথ্যা মামলা সাজিয়ে
নন্দকুমারের মত উচ্চ পদমর্যাদার মানুষকে ফাঁসিতে লটকে দিল (৫ই অগস্ট ১৭৭৫) । নগর
কলকাতা দেশের প্রথম ফাঁসি দেখলো (কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৭৭৩এ) ।
কয়েক হাজার মানুষ গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য নাকি দেখেছিলেন ।
তখনও কলকাতায়
ছাপাখানা আসেনি, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়নি । ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ
রামমোহন রায় তখন প্রত্যন্ত হুগলীর খানাকুলে মাতৃক্রোড়ে তিন বছরের শিশু । ছাপাখানা
এল ১৭৮০তে, ছাপাখানা বসালেন জেমস অগস্টাস হিকি ।
( চলবে ...)
তথ্যসূত্র -
‘কলকাতা তিনশতক’ /কৃষ্ণ ধর এবং কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (২য় খন্ড)’ / বিনয় ঘোষ ।
No comments:
Post a Comment