পাঠকের পছন্দ

Wednesday, September 23, 2015

কথা কলকাতাঃগোরুর গাড়ি থেকে জেটযুগ

কলকাতার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা : গোরুর গাড়ি থেকে জেট যুগ

আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্য ইতিহাসের পাতা ভর্তি হয়েছে রাজা-রাজড়াদের উথ্বান-পতন আর যুদ্ধ, খুন ও ষড়যন্ত্রের কাহিনি দিয়ে । সেখানে সামাজিক ইতিহাসের উপাদান খুজে পাওয়া যায় না ।  বেশি দিন আগের কথা বলছি না । তিনশ’ বছর আগেও মানুষ দূর পথে যাতায়াত করতো কি ভাবে ? জানতে কৌতুহল হয় । সর্বকালে, সর্বদেশেই মানুষের দুটি পা ভিন্ন তার যাতায়াতের আদিমতম উপায় ছিল নদীপথ । দুশ’ বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর আট বছর বয়সে পিতার সঙ্গে বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতা এসেছিলেন হাঁটাপথে । আরো পনেরো বছর পরে ১৮৪৩এ জর্জ এভারেস্ট, যার নামে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম, দেরাদুন থেকে বরাবর নদীপথে কলকাতা এসেছিলেন । সময় লেগেছিল ৩৫ দিন । তারও পনেরো বছর পরে ১৮৫৬তে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে কাশী গিয়েছিলেন নদীপথে নৌকায় । যদিও তখন অল্প-বিস্তর রেল লাইন পাতা শুরু হয়েছিল । সময় লেগেছিল দেড় মাস আর নৌকা ভাড়া লেগেছিল একশ’ টাকা । কিন্তু হাঁটাপথ বা নদীপথ নয়, আমি বলবো কলকাতার সড়কপথে যাতায়াতের কথা, সড়ক পরিবহন বন্দোবস্তের বেড়ে ওঠার কথা ।

আমরা চলতি কথাবার্তায় একটা জমজ শব্দ প্রায়ই বলি ‘গাড়ি-ঘোড়া’ । যেমন, হরতালের দিন রাস্তাঘাট শুনসান, ‘গাড়ি-ঘোড়া’র দেখা নেই – এই রকম । কথায় ঘোড়ার আগে গাড়ি থাকলেও আসলে কিন্তু গাড়ির অনেক আগে ঘোড়া এসেছে । মানুষ বা মালপত্র বইবার জন্য পশুশক্তির ব্যবহার হয়ে আসছে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই । এখনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাল পরিবহনতো বটেই মানুষ পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ির ব্যবহার হয় ।  এখন এই আধুনিক জেট-গতির যুগে বিস্ময়কর লাগে, প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৭৮এর সেপ্টেম্বর মাসে স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবনমোহিনী বালক নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে বাগবাজার থেকে মধ্যপ্রদেশের (এখন ছত্তিশগড়) রায়পুরে গিয়েছিলেন গোরুর গাড়িতে চেপে । রায়পুরের দূরত্ব প্রায় সাড়ে আটশ’ কিলোমিটার । বিবেকানন্দের পিতা ভুপেন্দ্রনাথ রায়পুরে এটর্নি ছিলেন ।  স্থলপথে দূর-দূরান্তে যাওয়ার গোরুর গাড়ি ছাড়া আর উপায়ই বা কি ছিল ? সেকথা থাক । গোরুর গাড়ির কথা পরে বলা যাবে । ঘোড়ার কথা বলি ।

আধুনিক কোন শহরে যানবাহন বা পরিবহন ব্যবস্থার বিবর্তন বড় বিচিত্র, কলকাতার কথাই ধরা যাক । বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গতিময় জনবহুল শহর, কি ভাবে আজকের আধুনিক গতি পেল তা জানতে ইচ্ছে করে । কলকাতা প্রাচীন শহর নয় মোটেই । বয়স মাত্র তিনশ’বছর এবং কলকাতার বিকাশও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি । এদেশে বানিজ্য করতে আসা ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের বানিজ্যকুঠী বানানোর জন্য বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে সুতানূটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের জমিদারি সত্ব কিনেছিল । সেই তিনটি গ্রাম মিলেই কলকাতা । এসব কথা স্কুল-কলেজের পাঠ্য ইতিহাসে লেখা আছে, সেটা আমার বলার কথা নয় । একটা শহরের বিকাশ ও আধুনিকতার মাপকাঠি তার জনবিন্যাস, শিক্ষা ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বানিজ্য । ইংরেজ কোম্পানী তিনটি গ্রামের জমিদারি সত্ব কিনেছিল ১৬৯৮এর ১০ই নভেম্বর । ঐ দিনই সাবর্ণচৌধুরী ও কোম্পানীর মধ্যে বিক্রয় দলিল সই হয়েছিল ।

কলকাতার নগরায়ন শুরু হয়েছিল আরো পঞ্চাশ বছর পর থেকে, ১৭৫৭র পলাশীর যুদ্ধের পর, কেননা এরপরই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে তাদের দখলদারি পাকা করেছিল সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত ও হত্যা করে । তো এই নতুন ‘নগর কলকাতা’র পত্তনের সময়কার চেহারাটা একবার দেখে নেওয়া যাক । ১৭০৬ খৃষ্টাব্দে মুঘল আমলে কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানূটি গ্রামের জরীপের তথ্য অনুযায়ী এই তিনটি গ্রা্ম- যা নিয়ে ‘নগর কলকাতা’, তার মোট জমির পরিমান ছিল ৫০৭৬ বিঘা । যার মধ্যে ১৫২৫ বিঘা ছিল ধানক্ষেত, ৪৮৬বিঘায় বাগান, ২৫০বিঘায় কলাগাছ,১৮৭বিঘাতে তামাক চাষ ও ১৫০বিঘায় শাক-সজির চাষ । ১১৬বিঘাতে ছিল রাস্তা, খাল, পাতকূয়া ও পুকুর আর ১১৪৪ বিঘা ছিল পতিত । এই ছিল পত্তনের সময়কার ‘নগর কলকাতার’ চেহারা ।  তখন নগর কলকাতায় মাত্র দুটি ‘স্ট্রিট’ আর দুটি ‘লেন’, রোড বা চওড়া রাস্তা একটাও ছিলনা । রাস্তা নেই তো গাড়ি গড়াবে কি করে ? অগত্যা এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে বা এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় যাতায়াত করার উপায় ছিল শরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে পায়ে হাঁটা, কিংবা গোরুর গাড়ি নয়তো পালকি । এই দুটি যানই স্থলপথে যাতায়াতের জন্য আমাদের আদি গ্রামীণ বন্দোবস্ত । পালকি স্বচ্ছল লোকেদের পক্ষের ব্যবহার করা সম্ভব হ’ত । কলকাতার নগরায়ন শুরু হওয়ার পরও ‘পালকি’ সম্ভ্রান্ত ও অর্থবান বাঙ্গালিদের ও সাহেবদের কাছে ছিল খুব আদরের । এ ছিল আদি ‘নগর কলকাতা’র বাবু কালচারের অন্যতম প্রধান চিহ্ন । সওয়ারি হত দুজন, বইতো ৬জন বেহারা, মালপত্র বওয়ার জন্য কুলি আর রাতের পথে একজন মশালচি ।

সাহেবরা কলকাতা নগরীর পত্তন করলো মানে দ্রুত গতিতে সে এগিয়ে চললো এমন নয় মোটেই । পত্তনের পর আরো একশ বছর কলকাতার চেহারাটা প্রায় একই রকম ছিল । যাতায়াতের জন্য কয়েকটা শরু কাঁচা রাস্তায় গোরুর গাড়ি আর পালকি ভরসা । প্রথম বড় চওড়া খোয়া বাধান রাস্তা সার্কুলার রোড তৈরী হয়েছিল ১৭৯৮/৯৯ নাগাদ, ফলে তখন থেকেই ছুটতে লাগল দ্রুত গতির ঘোড়ায় টানা গাড়ি । আর ঘোড়া মানেই গতি, দ্রুত গতির প্রতীক । এরপর, আরো এখশ’ বছর ঘোড়ায় টানা গাড়িই ছিল নগর কলকাতার একমাত্র দ্রুতগতির যানবাহন । যাত্রীবাহী মোটর বাস কলকাতায় চলতে শুরু করেছিল ১৯২২ থেকে । তার আগে অবশ্য ট্যাক্সি চলা শুরু হয়েছে ১৯০৬ থেকে ।

ঘোড়ার গাড়ির চল হওয়া শুরু হতেই কলকাতার জনজীবনে গতি এলো । অনেক রাস্তা তৈরী হল । কলকাতার রাস্তা-ঘাট তৈরী করার জন্য ইংরেজরা একটা ‘লটারি কমিটি’ করেছিল, লটারির টাকায় শহরের নানান উন্নয়ন করা হ’ত । ওয়েলসলি সাহেব তখন গভর্ণর জেনারেল । ১৮৩৬ সালের মধ্যে কলকাতায় অনেক প্রধান রাস্তার নির্মাণ হয়ে গেল । স্ট্রান্ড রোড, কলেজ স্ট্রিট,আমহার্স্ট স্ট্রিট,মির্জাপুর স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট প্রভৃতি । ১৮৮৮ পর্যন্ত কলকাতার মোট রাস্তার পরিমান ছিল ১৮২ মাইল । ঐ বছরেই  ‘নগর কলকাতা’র আয়তন বাড়লো । এন্টালি, বেনেপুকুর, ট্যাংরা, তপসিয়া,বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, কালিঘাট, চেতলা, আলিপুর ও খিদিরপুর । নগর কলকাতার সেইসব রাস্তা এখনকার মত মসৃণ এসফল্ট বা পিচ বাঁধান ছিল না । ছিল খোয়া বাঁধান । কারণ ১৯১০এর আগে এসফল্ট বা বিটুমিন’এর ব্যবহার জানা ছিল না । ঐসব রাস্তা দিয়ে ছুটতো ঘোড়ার গাড়ি ।

 গাড়ি টানার কাজে ঘোড়াকে নানান উপায়ে ব্যবহার করা হত। উদ্দেশ্য দ্রুতগতিতে যাতায়াত । ব্রাউনলো নামে এক সাহেব বের করলেন ‘ব্রাউন বেরি’ নামে গাড়ি । সাবেকি পালকিতেই চারটি চাকা বসিয়ে সামনে ঘোড়া জুতে দিয়ে বানিয়ে ফেললো এক ঘোড়ায় টানা ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি, ১৮২৭এ  । ব্রাউন বেরির ভাড়া ছিল প্রথম একঘন্টায় চোদ্দ আনা, পরের প্রতি ঘন্টায় আট আনা আর সারা দিনের জন্য নিলে চার টাকা । নানান ধরনের ঘোড়ার গাড়ি ছিল । সাহেবদের জন্য দামি গাড়ি , সাধারণ কর্মচারিদের জন্য আলাদা গাড়ি । নানান নামের এইসব ঘোড়ার গাড়ি । চেরট, ফিটন, ল্যান্ডো, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এইরকম । অনেক বড় বড় কোম্পানী হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি তৈরী করার জন্য । এক্কা গাড়ি, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এসব নামগুলো প্রবাদের মত হয়ে গেছে । বহু যুগ ধরে বাংলা বর্ণমালায় পড়া “এক্কা গাড়ি ঐ ছুটেছে, ঐ দেখো ভাই চাঁদ উঠেছে”, বহুদিন অতীত হয়ে গেছে কলকাতার রাস্তা থেকে । তবু গোড়ার গাড়িই বোধয় কলকাতার সবচেয়ে ‘নস্টালজিক হেরিটেজ’ । এককালে কলকাতার ‘বাবু’রা ফিটনে চেপে ময়দানে হাওয়া খেতেন । আর সেই ঐতিহ্যের পথ বেয়ে এই সেদিনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে সারি দেওয়া ফিটন গাড়ি দেখা যেত ময়দানে শখের হাওয়া-ভ্রমণের জন্য । ২৬শে মার্চ ২০১২ থেকে তাদেরও বিদায় করা হয়ে গেছে ।

ইতিমধ্যে ১৮৫৪ সালের অগষ্ট মাস থেকে হাওড়া স্টেশন থেকে হুগলী পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে গেছে । কিন্তু কলকাতার ভেতরে একসঙ্গে বেশি পরিমান মালপত্র বইবার বা একসঙ্গে অনেক মানুষের যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা ছিলনা । সেই অসুবিধা দূর হল, ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু করে । মার্চ ১৮৭০ থেকে তোড়জোড় শুরু করে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বউবাজার, ডালহৌসি স্কোয়ার স্ট্রান্ড রোড হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত পাতা হল ট্রাম লাইন আর ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ থেকে ঘোড়ায় টানা ট্রাম গাড়ি চলা শুরু করলো । দুটো বলিষ্ঠ ঘোড়া দিয়ে চালানো হত ট্রাম । এরপর অনেক রাস্তায় ট্রাম লাইন পাতা হল, কলকাতা ট্রামওয়েস কোম্পানী গঠন হল । ঘোড়ায় টানা ট্রামই হয়ে উঠলো কলকাতার প্রথম গণপরিবহন ব্যবস্থা । ১৮৯০-৯১ সনে কলকাতায় ট্রাম টানবার জন্য ঘোড়ার সংখ্যা ছিল একহাজার, সবই শীতপ্রধান দেশ থেকে নিয়ে আসা বেশ বলবান ঘোড়া । প্রায় ত্রিশ বছর চালু ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রামের ব্যবস্থা । ঘোড়ায় টানা ট্রামের যুগ শেষ হল ১৯০২এ পৌছে । ২৭শে মার্চ ১৯০২ এ প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চলতে শুরু করলো ধর্মতলা – খিদিরপুর পথে । তার আগে কিছুদিন পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি পথে বাষ্পীয় ইঞ্জিন দিয়ে ট্রাম চালানো হয়েছিল । এখন  তো কলকাতার  কয়েকটা মাত্র পথে ট্রাম চলে  ।

১৮৮৬ সনে জার্মানীতে মোটরগাড়ি আবিষ্কার হওয়ার পর দশ বছরের মধ্যেই কলকাতার রাস্তায় মোটর গাড়ি দেখা দিল, আর তার দশবছর পরে ১৮৯৬এ কলকাতায় চলে এলো ট্যাক্সি । ১৯৪০/৪৫ সাল নাগাদ কলকাতায় ট্যাক্সির ভাড়া ছিল কমপক্ষে আট আনা, তারপর প্রত্যেক ১/৪ মাইলের জন্য দু’আনা । তখন যাতায়াতের জন্য কলকাতায় প্রধান উপায় ছিল ট্রাম । কিন্তু শহরের বাইরে, দূরে যাওয়ার সমস্যা ছিল, কারণ ট্যাক্সিতে খরচ বেশি । অবশেষে ১৯২২ সনে কলকাতায় চালু হয়ে গেল যাত্রীবাহী মোটর বাস ।  এর অনেক আগে - মোটর গাড়ি আবিষ্কারই হয়নি, তখন কিছু দিনের জন্য ঘোড়ায় টানা বাস চলার কথা জানা যায় । ধর্মতলা থেকে বারাকপুর পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা বাস চলেছিল ১৮৩০ সনে । কতদিন চলেছিল – এসব তথ্য জানা যায় না । ১৯২২ থেকে মোটর বাসই হয়ে গেল কলকাতার প্রধান গণ পরিবহন ব্যবস্থা । চালু হওয়ার সময় ১৯২৪এ কলকাতায় বাসের সংখ্যা ছিল ৫৫টি । সেই সংখ্যাটা ১৯২৫ সনে হয় ২৮০ । ১৯২৬এ চালু হয় দোতলা বাস । প্রথম দোতলা বাস চলেছিল শ্যামবাজার থেকে কালিঘাট । প্রথম চালু হওয়া দোতলা বাসগুলি বছর কুড়ি আগে দেখা বা ছবিতে দেখা বাসের মত ছিল না । বাসগুলির ওপরে ছাদ বা ছাউনি থাকতোনা । বর্ষায় যাত্রীরা ছাতা মাথায় বসে থাকতেন । ৮০রদশক পর্যন্তও বেশ কিছু প্রধান রাস্তায় দোতলা বাস চলতো । তারপর ১৯৯০ থেকে সেই সময়ের সরকার দোতলা বাস চালান বন্ধ করে দেয় । এখনও অনেকেই দোতলা বাসে চড়ার স্মৃতি রোমন্থন করে তৃপ্তি লাভ করেন । এখন নানা চেহারায় এই যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা – বাস, মিনিবাস, অটো ইত্যাদি । ১৯৪৮ থেকে সরকারী বাস চলাচল ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, গঠিত হয় স্টেট ট্রানসপোর্ট কর্পোরেশন । এখন অবশ্য সরকারি বাস সামান্যই চলে । ১৯৭৫এ চালু হয় ‘মিনিবাস’ । সেই সময় যারা মিনিবাসে চড়তেন তাদের মনে পড়বে, সেগুলির উচ্চতা বেশ কম ছিল, যার জন্য সাধারণ উচ্চতার যাত্রিকেও দাঁড়িয়ে যেতে হলে সারাক্ষণ ব্যথা সহ্য করেও বাসের মধ্যে ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো । এই গণ পরিবহন  ব্যবস্থার বয়স আপাতত অতয়েব একশ’ বছরেরও কম । 


কলকাতা বড় বিচিত্র শহর । এই জেটগতির যুগে দ্রুতগতির আধুনিক পরিবহন বন্দোবস্তের পাশাপাশিই মানুষ টানা রিকশর সহাবস্থান । ২০০৬এ পশ্চিমবঙ্গ সরকার টানা রিকশর চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল । তারপর ধীরে ধীরে কলকাতা থেকে এই ঔপনিবেশিক চিহ্নটি বিদায় নেয় । রিকশ'র জন্ম জাপানে, ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে । জাপানী ভাষায় এ গাড়িকে বলা হত জিন-রি-কি-শ , মানে 'মানুষ টানা গাড়ি' । ভারতে প্রথম বলা হত 'জিন রিকশ' । সেটা ছোট হয়ে 'রিকশ' হয়েছে । সিমলা তে এই গাড়ি প্রথম দেখা যায় ১৮৮০তে। লেডি ডাফরিনের আত্মকথায় আছে । কলকাতায় চিনারা প্রথম নিজেদের ব্যবহারের জন্য রিকশ'র প্রচলন করে ১৯০০/১৯০১ সন নাগাদ । তারপর চিনারা, ভাড়ায় রিকশ' চালানো শুরু করে ১৯১৩/১৪ থেকে । ভারতীয়রা রিকশর ব্যবসা শুরু করে ১৯২০ থেকে । ইংরেজ আমলে টানা রিকশ'র ভাড়া ছিল এক মাইল পর্যন্ত - তিন আনা । তার পরের প্রতি মাইলের জন্য তিন আনা। সময়ের হিসাবে একঘন্টার জন্য ছ আনা । এটা দুজনের বসার হিসাব। একজন হলে দেড় আনা প্রতি মাইল , একঘন্টার জন্য তিন আনা ।

স্বল্প দূরতের পথে যাতায়াতের জন্য তিন চাকার সাইকেল রিকশ এখনও মানুষের পরিহার্য বাহন । কলকাতার রাস্তায় সাইকেল রিকশ চালু হয়েছিল ১৯৪০ নাগাদ । তার পঞ্চাশ বছর আগেই অবশ্য দুই চাকার ব্যক্তিগত বাহন বাই-সাইকেল প্রচলিত হয়েছিল ১৮৮৯ সালে ।

মানুষ ও মালপত্রের বহন ছাড়াও চিঠিপত্র বা ডাক দূর দূরান্তে পৌছে দেবার কিরকম বন্দোবস্ত ছিল এবার সেটাও দেখি । পাঠ্য ইতিহাসে পড়েছি শের শাহ ঘোড়ার মাধ্যমে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন । তখন মানুষ ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বা ডাকের ব্যবহারই জানতো না । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকালে ডাকব্যবস্থা গড়ে ওঠে । দূর-দূরান্তে, অন্য প্রদেশে ডাক নিয়ে যাবার জন্য মানুষ বওয়ার মত একই রকম ব্যবস্থা ছিল অর্থাৎ পালকি, গোরুর গাড়ি ও ঘোড়ায় টানা পালকি গাড়ি ।
এখন, এই একুশ শতকে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা কোন উচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছে তা আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় দেখছি । সে প্রসঙ্গ আমার বিষয় নয় । আমি শুধু কলকাতার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার আদিপর্বের কিছু তথ্য তুলে এনেছি আর তার বিবর্তনটা বুঝতে চেয়েছি । সর্ব দেশেই সভ্যতার অগ্রগতির ধাপগুলো একই – পেশী শক্তি,পশুশক্তি এবং তারপর যন্ত্রশক্তি । আর এই সবের নিয়ন্ত্রক অবশ্যই মানুষের মস্তিষ্ক । সুতরাং সেই একই ধারায় নগর কলকাতার সড়ক পরিবন ব্যবস্থা নানান ধাপ পেরিয়ে আজকের জেট-গতি যুগে এসেছে । আমি সেই ধাপগুলি ছুঁয়ে যেতে চেয়েছি ।
তথ্যসূত্র -

(১) কলিকাতা দর্পণ / রথীন্দ্রনাথ মিত্র,(২) কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত / বিনয় ঘোষ (৩) সংবাদপত্রে সেকালের কথা / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়



Tuesday, September 22, 2015

কথা কলকাতা - ছয়

কথা কলকাতা - ৬

যে শহর ছাপাখানা, সংবাদপত্র আর বইএর নাগাল পেয়েছে তাকে কে আর ধরে রাখবে ? কলকাতা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললো । নতুন যুগে নতুন মহানগরে যুগমানসের অভিব্যক্তি লিখে রাখছে ইতিহাস । বিজ্ঞান,ব্যক্তি স্বাধীনতা,সংস্কারমুক্তি, গণতন্ত্র ও শিক্ষার নূতন ভাবাদর্শে উদবুদ্ধ কলকাতা । শুরু হয়েছে নানান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড । নবযুগের বাংলার নবজাগৃতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠলো নগর কলকাতা । ১৮৩০ সালের মধ্যে কলকাতাতে ১১ট ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হল । ১৮৪৬ থেকে ১৮৫০এর মধ্যে লন্ডনের ৯টিব্যাঙ্কের শাখা এবং ভারতের অন্য প্রদেশের ৭টি ব্যাঙ্কের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল । কলকাতা অতয়েব ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে গেল । ১৮৫৭তেস্থাপিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ।

কলকাতার রাস্তাঘাটের শ্রীবৃদ্ধি কিন্তু এর অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক প্রাধান্যের সঙ্গে তাল রেখে হয়নি । আগে লটারির টাকা থেকে রাস্তাঘাটের নির্মাণ হত । ১৮৩৬এ লটারি কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয় ও স্থির হয় প্রতিবছর ২৫হাজার টাকা খরচ করা হবে রাস্তাঘাট তৈরী করার জন্য । ১৮৬৩ থেকে ১৮৮০ সনেরমধ্যে তৈরী হল ফ্রীস্কুল স্ট্রীট থেকে ধর্মতলা স্ট্রীট (১৮৬৪), ক্যানিং স্ট্রীট(১৮৬৫), বিডন স্ট্রীট (১৮৬৮), গ্রে স্ট্রীট (১৮৭৩) । ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত কলকাতায় মোট রাস্তার পরিমান ছিল ১৮১ মাইল,তারমধ্যে ৩৪মাইল ছিল খোলা নর্দমা বুজিয়ে করা সরু গলি । ১৮৮৮তে এন্টালি, বেনেপুকুর,ট্যাংরা, তপসিয়া, বালিগঞ্জ, খিদিরপুর,ভবানীপুর, কালিঘাট, চেতলা ও আলিপুরঅঞ্চলগুলিকে কলকাতার অন্তর্ভুক্ত করা হয় । সেই সময় ল্যান্সডাউন রোড, হরিশ মুখার্জী রোড, হাজরা মোড়, আপারসার্কুলার রোড,কালিটেম্পল রোড, গোপালনগর রোড প্রভৃতি রাস্তাগুলি তৈরী হয় ।

১৮৫৪র ১৫ই অগস্ট হাওড়া থেকে হুগলী প্রথম রেলগাড়ি চললো । সেই প্রথম ট্রেন সকাল সাড়ে আটটায় হাওড়া ছেড়ে হুগলী পৌছায় সকাল ১০টা১মিনিটে । অর্থাৎ হাওড়া থেকে হুগলী এই ২৪ মেইল রেলপথে সময় লেগেছিল ১ঘন্টা ৩১ মিনিট। রেল গাড়ি চলছে, সে এক অবাক করা কান্ড যেন ! তিন হাজারেরও বেশি লোক প্রথম দিনেররেলে চড়ার জন্য লাইন দিয়েছিাইল! তুলনায় অল্প কিছু লোককেই যায়গা দেওয়া গিয়েছিল । তখন হাওড়াতে নয়, টিকিটঘর ছিল আর্মেনিয়ান ঘাটে সেখান থেকে টিকিট কেটে স্টীমারে করেহাওড়া গিয়ে ট্রেনে চাপতে হত ।  রেল চালুহওয়ার  ষোল সপ্তাহ পরে যাত্রী পরিবহনেরএকটা হিসাব করা হয়েছিল । সেই হিসাব অনুযায়ী প্রথম ১৬ সপ্তাহে রেলে যাত্রী পরিবহনহয়েছিল - প্রথম শ্রেনীতে ৫৫১১ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২১,০০৫ এবং তৃতীয় শ্রেণীতে ৮৩,১১৮জনযাত্রী । ১৮৫৪তে প্রথম রেল চলার ৮বছরের মধ্যেই ১৮৬২তে আটঘন্টা কাজের দাবিতে হাওড়া স্টেশনে রেলের ১২০০ মজুর ধর্মঘট করে । সেটাই ছিল ভারতের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট ।
কলকাতার ভেতরে একস্থান থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য ছিল সেই ঘোড়ায়  টানা ছ্যাকরা গাড়ি আর পালকি । গোরুর গাড়ি করেও দূর দূরান্তে যেতে হতো । ১৮৭৮ সনের অগস্ট মাসে তখনও বেঙ্গল-নাগপুর রেললাইন হয়নি । ভাষাবিদ হরিনাথ দের মাতা এবং বিবেকানন্দের মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী শিশু হরিনাথ ও বালক বিবেকানন্দকে নিয়ে আড়িয়াদহ গ্রাম থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে গিয়েছিলেন গোরুর গাড়িতে করে ।

১৫ই নভেম্বর ১৮৬২ থেকে শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়াপর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয় । প্রথমে শিয়ালদহ স্টেশন বলতে একটা টিনের চালের ঘর ছিল। বড় আকারে শিয়ালদহ মেন স্টেশন তৈরী হয় ১৮৬৯ সনে ।

কলকাতা থেকে দূরে যাবার জন্য ছিল নদীপথ । কলকাতার আসেপাশের খালপথ দিয়ে নৌকা বোঝাই করে মালপত্র আসতো পূর্ববঙ্গ থেকে । দূরদূরান্তে ভ্রমণের জন্যও ছিল নদীপথ । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে বর্নণা আছে যে, ১৮৫৬ সনে দেবেন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে কাশি (বেনারশ) গিয়েছিলেন নৌকা করে । সময় লেগেছিল দেড়মাস আর নৌকা ভাড়া লেগেছিল ১০০টাকা ।

ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩এর আগে কলকাতায় দ্রুতগতির মাল ও যাত্রীবহন গাড়ি বলতে ছিল ঘোড়ায় টানা গাড়ি । নানা ধরনের গাড়ি তৈরী হত । চ্যারিয়ট,ফিটন,ব্রাউনবেরি,বগি গাড়ি এইসব, আর দেশীয় লোকেদের জন্য ছ্যাকরা গাড়ি । ২৪শেফেব্রুয়ারি ১৮৭৩এ কলকাতায়  প্রথম ট্রাম চালু হয় শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত, ঘোড়ায় টানা দুই কামরার ট্রাম ।আর্মেনিয়ান ঘাটে রেলের টিকিটঘর ছিল । সেখান থেকে স্টিমারে হাওড়া স্টেশন যেতে হত । ১৮৯০-৯১ সনে ট্রাম কোম্পানীর কর্মচারী সংখ্যা ছিল ২২৫০ আর ঘোড়ার সংখ্যা ছিল ১০০০ । বিদ্যুৎ শক্তি চালিত ট্রাম আসে অনেক পরে ১৯০২এর ১৪ই জুলাই থেকে এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর । ভাড়া ছিল প্রথম শ্রেণীতে দু আনা বা এখনকার১২পয়সা । 

১৮৭২এ কলকাতা বিনোদনের নতুন বন্দোবস্ত থিয়েটার পেয়ে গেল । চিৎপুরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি মধুসূদন সান্যালের বাড়ির উঠনে ন্যাশানাল থিয়েটার নাম দিয়ে তৈরী হলদেশের প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় । ৬ই ডিসেম্বর ১৮৭২ দীনবন্ধু মিত্রর নীলদর্পণনাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করল বাঙ্গালীর থিয়েটার ।

কলকাতায় দু চাকার সাইকেল এল ১৮৮৯ । কলকাতায় দু চাকার সাইকেলের আদি প্রবর্তক ছিলেন হেমেন্দ্রমোহন ঘোষ, হ্যারিসন রোডে প্রথম সাইকেলের দোকান খোলেন । তিনি তিনজন বিখ্যাত মানুষ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু,আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও ডাক্তার নীলরতন সরকারকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলেন ।
১৮৬৮তে কলকাতায় বড় পোষ্ট অফিস হ, জিপিও । ১৮৬৪তে শুরু হয়েছিল, তৈরী হতে সময় লেগেছিল চার বছর । এখানেই আগে পুরাতন কেল্লা ছিল।

কলকাতা তখনও বিদ্যুতের আলো দেখেনি । বিদ্যুতের আলো সম্পর্কে কলকাতা জানলো ১৮৭৯এ । ১৮৮৫তে দে শীল এন্ড কোম্পানীচিৎপুরে এক ধণাঢ্য লোকের বিয়ের শোভাযাত্রায় আলোর ব্যবস্থা করেছিল । ১৮৮৬তে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনেও বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা হয়েছিল । কিন্তু ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছিল অনেক পরে । ১৮৯৫তে সরকার আইন পাশ করে কলকাতার ৫.৬৪  বর্গমাইল এলাকায় বিদ্যুতসরবরাহের লাইসেন্স দেয় লন্ডনের ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর কলকাতার এজেন্টকে এটাই পরে হয়ক্যালকাটা ইলেট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন। ১৮৯৯এর এপ্রিল মাসে প্রিনসেপ ঘাটে তারা প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরী করে । প্রথম রাস্তার আলো জ্বলে হ্যারিশন রোড ওজগদীশচন্দ্র বোস রোডএ । বিদ্যুতের আলো এল বটে, কিন্তু খুব বেশি গ্রাহক আকর্ষিত হলনা ইউনিট পিছু দাম অত্যধিক বেশি হওয়ার কারণে । ১৯০১এর মধ্যে মাত্র ৭০৮টি বাড়িবিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছিল । ইউনিট পিছু দাম ছিল আট আনা । গ্রাহক কম হওয়ার কারণে পরে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দিয়েছিল ।

এইভাবে, ইটভাঙ্গা খোয়ার রাস্তা, ছ্যাকরা গাড়ি,গোরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা ট্রাম আর গ্যাসের আলো নিয়ে কলকাতা পা দিল বিশ শতকে । বিশশতকের গোড়াতেই কলকাতা পেলো কলের গান বা গ্রামফোন । দমদেওয়া যন্ত্রে একটা কালো গালার চাকতিতে রেকর্ড করা গান সেই যন্ত্রে লাগান একটা চোঙ্গার মধ্যদিয়ে শোনারব্যবস্থা । প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড করেছিল থিয়েটারের দুই নাচবালিকা শশিমুখী ও ফণিবালা ১৯০২ সনে । একই সময়ে ঘোড়ায় টানা ট্রামের যুগ শেষ হয়ে বিদ্যুত শক্তিতেট্রাম চালানো শুরু হল । ২৭শে মার্চ তারিখে প্রথম এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হল ।

১৯১১তে বঙ্গ ভঙ্গ প্রস্তাব রদ হল বটে, কিন্তু কলকাতাআর বৃটিশ ভারতের রাজধানী থাকলো না । ১৯১২তে গঠিত হল ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট’, তারা নগরায়নের কিছু বন্দোবস্ত করলো । এরা প্রথম যে রাস্তাটি বানিয়েছিলসেটি সেন্ট্রাল এভিনিঊ - ১৯২৬ থেকে যার নামহয় চিত্তরঞ্জন এভিনিউ । উত্তর কলকাতার রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট, বিবেকানন্দ রোড , গ্রে স্ট্রীট, রাসবিহারী এভিনিউ এই সময়কালেই নির্মিত । ১৯২৪ থেকেই কলকাতার খোয়ার রাস্তাগুলো এসফল্ট,পীচদিয়ে পাকা করার কাজ শুরু হয় । তার আগে এসফল্টের ব্যবহার কলকাতার জানা ছিল না ।১৯৪৩এর ৩রা ফেব্রুয়ারি৮২ফিট উঁচু আর ১৫০০ফিট লম্বা নতুন হাওড়া ব্রীজ খুলে গেল । 

বাসেরচেয়েও আগে এসেছিল ট্যাক্সি । কলকাতার রাস্তায় প্রথম ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো ১৯০৬থেকে । অনেকদিন পর্যন্ত প্রায় ১৯৪০-৪৫ পর্যন্ত ট্যাক্সির ভাড়া ছিল কমপক্ষে আট আনাতারপর সিকি মাইলের জন্য দু আনা । কলকাতায় যাত্রীবাহী বাস চালু হল ১৯২২এ । ১৯২৪এ কলকাতায় বাসের সংখ্যা ছিল ৫৫টি আর একবছর পরে ১৯২৫এ বেড়ে হয় ২৮০টি ।

গোরাউপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ তখনকার কলকতারকাব্যিক বর্ণনা দিয়েছিলেন এইভাবে – “শ্রাবণ মাসের সকালবেলা মেঘ কাটিয়া গিয়া নির্মলরৌদ্রে কলিকাতার আকাশ ভরিয়া গিয়াছে । রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বিরাম নাই,ফেরিওয়ালা অবিশ্রাম হাঁকিয়া চলিয়াছে,যাহারা আপিসে, কলেজে, আদালতে যাইবে তাহাদের জন্য বাসায়বাসায় মাছ-তরিকারির চুপড়ি আসিয়াছে ও রান্নাঘরে উনান জ্বালাইবার ধোঁয়া উঠিয়াছে কিন্তু তবু এত বড় এই যে কাজের শহর কঠিন হৃদয় কলিকাতা, ইহার শতশত রাস্তা এবং গলিরভিতর সোনার আলোকের ধারা আজ যেন একটা অপূর্ব প্রবাহ বহিয়া লইয়া চলিয়াছে

এইভাবে প্রাণের অপরূপ প্রবাহ নিয়ে নগর কলকাতা পৌছে গেল ১৯৪৭এর ১৫ই আগস্টে । সঙ্গে নিয়ে এলো তেতাল্লিশের মনুষ্য সৃষ্ট মন্বন্তর, ভাতৃঘাতি দাঙ্গার স্মৃতি, উদবাস্তু স্রোত আর দেশভাগের সুতীব্র ক্ষত ।
কথা কলকাতা আপাতত শেষ । এ শুধু ইট-কাঠের কলকাতার বেড়ে ওঠার কিছু বিবরণ । পরবর্তী পর্যায়ে কলকাতার মানুষ-সমাজ-সংগ্রাম আর রাজনীতি,যা কলকাতার অহংকার কলকাতার অলংকার ।

তথ্যসূত্র - বাংলার নবজাগৃতি / বিনয় ঘোষ, কলিকাতা দর্পণ / রথীন মিত্র , সংবাদপত্রে সেকালের কথা / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়


কথা কলকাতা - পাঁচ

কথা কলকাতা – ৫

কলকাতার নগরায়ন স্বাভাবিক পথে হয়নি । ইংরেজ তার বণিকি স্বার্থে পরিকল্পনাহীন ভাবে নগর কলকাতার পত্তন ঘটিয়েছিল আর তাকে ঘিরে  গড়ে উঠেছিল ইংরাজের দালালি করা এক লোভি, দূর্নীতি পরায়ন, অলস নাগরিক সমাজ । আঠেরো শতকের কলকাতা ছিল এদেশীয় দালাল, মুৎসুদ্দি , বেনিয়াদের কলকাতা আর উনিশ শতকে ‘বাবু’ কলকাতা । আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কলকাতার সেই বাবুসমাজের বর্ণনা দিয়েছেন এইরকম – “ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিছু বর্ণনা করিব ? মুখে,ভ্রুপার্শে ও নেত্রকোণে নৈশ অত্যাচারের চিহ্ন স্বরূপ কালিমারেখা  । শিরে তরঙ্গায়িত বাবরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে কালোপেড়ে ধুতি । অঙ্গে উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান,গলদেশে উত্তমরূপে চুনোট করা উড়া্নী এবং পায়ে পুরু বাগলস সমন্বিত চিনাবাড়ির জুতা । এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া বুলবুলের লড়াই দেখিয়া,সেতার, েসরাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, আফ আখরাই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের মেলা, মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময় কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিয়া থাকিত” ।

কিন্তু উনিশ শতকের এই ভ্রষ্টাচারী ‘বাবু’ শ্রেণীটাই কলকাতার আসল প্রতিনিধি ছিল না । রামমোহন ও ডিরোজিওর সমাজভাবনা ও মুক্তচিন্তার প্রভাবে যে নতুন আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল তারাই স্বাদেশিকতার আলো জ্বালিয়েছিলেন । ভারতবর্ষকে মাতৃভূমি রূপে কল্পনা করে প্রথম কবিতা লেখেন ডিরোজিও । তথাপি স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে সামগ্রিক ভাবে বাংলার কৃষক বা শ্রমজীবি মানুষের দুঃখ-দূর্দশা সম্পর্কে তাঁরা উদাসিনই ছিলেন । এই আলোকপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটির লক্ষ্য ছিল ইংরেজের সঙ্গে একত্রে প্রশাসনের ভাগীদার হয়ে তাদের সমান মর্যাদা অর্জন করা ।

ছাপাখানার আবির্ভাব কলকাতার নবীন প্রজন্মের মানসিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল । ১৮২৫-২৬ সালের মধ্যে কলকাতায় কুড়িটিরও বেশি ছাপাখানা বসে  গিয়েছিল । ইংরেজরা তাদের শাসনের কাজের জন্য কলকাতায় ছাপাখানা এনেছিল, এটা একটা ঘটনা মাত্র কিন্তু ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা ও ব্যবহারে এদেশীয়রা অনেক বেশি আগ্রহী ও তৎপর ছিল । উনিশ শতকে বাংলায় বুদ্ধির জাগরণে মুদ্রন যন্ত্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয় । বাংলার বুদ্ধির জাগরণে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুররা অগ্রপথিক, কিন্তু এদের সঙ্গে দুটি নাম নিশ্চিত ভাবেই সমান শদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় তাঁরা হলেন ত্রিবেণীর এক কর্মকার পঞ্চানন এবং শ্রীরামপুরের বহরা গ্রামের এক বাঙালি ব্রাহ্মণ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য । পঞ্চানন কর্মকার প্রথম বাংলা হরফ তৈরী করেন ১৭৮৪ সনে । আর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন । গঙ্গাকিশোর শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিষ্ট মিশনের ছাপাখানায় কম্পোজিটর ছিলেন, তারপর কলকাতায় । গঙ্গাকিশোরই কলকাতায় প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন । ১৮১৬তে প্রকাশিত ভরতচন্দ্রের ‘অন্দদামঙ্গল’ কলকাতায় ছাপা প্রথম সচিত্র বাংলা বই । বইটির কাটতি বাড়ানোর জন্য গঙ্গাকিশোর একটি দোকান খোলেন । সুতরাং গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই নগর কলকাতায় প্রথম বইএর দোকান খোলার পথ দেখিয়েছিলেন । ১৮১৮তে গঙ্গাকিশোর নিজেই একটি ছাপাখানা বসান এবং সেখান থেকে ‘বেঙ্গল গেজেটি’ নামে বাংলা সাময়িক পত্রের প্রকাশ শুরু করেন । সেটিই  বাঙালি প্রবর্তিত প্রথম সংবাদ পত্র । কলকাতা যে একদিন ‘গ্রন্থনগরী’তে পরিণত হ’ল তার আদি কারিগর গ্রামীণ বাংলা থেকে উঠে আসা এই দুজন – পঞ্চানন কর্মকার ও গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও আরো কয়েকজন । তখন রেলগাড়ি আসেনি, ডাক ব্যবস্থা শুরু হয়নি, কারখানার ভোঁ বাজতো না । তখন এরাই হয়েছিলেন কলকাতার সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রথম নেপথ্য পুরোহিত ।

১৮৩০এ কলকাতা তখনও প্রাসাদ নগরী হয়ে ওঠেনি । কিন্তু গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠার সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল । ১৮৩০এর ২৩শে অক্টোবর ‘সমাচার দর্পন’পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “কিন্তু দশ দশবৎসরাবধি ভারতবর্ষে মুদ্রাঙ্কনকার্য্যের অপূর্বরূপ বৃদ্ধি হইয়াছে এবং কলিকাতা নগরে ভুরিভুরি ঐ যন্ত্রালয় হইয়াছে । তদধক্ষ্যেরা এওক্ষণে প্রতিযোগিতারূপে এমত উদ্যোগ করিতেছেন যে কে কত উত্তমরূপে অথচ অল্পমূল্যে গ্রন্থাদি ছাপাইতে পারেন”। এই সময়ে অর্থাৎ রামমোহনের যুগেই কলকাতা থেকে ১৬টি ইংরাজি, ৪টি বাংলা ও ১টি ফারসি পত্রিকা প্রকাশিত হ’ত । মুদ্রন যন্ত্রের বিপুল প্রসার না ঘটলে এতগুলি পত্রিকার প্রকাশ সম্ভব হ’ত না । কলকাতায় প্রথম বাংলা বই ছাপা হয় ১৮১৬তে, আর ১৮২৯এর ‘সমাচার দর্পণ’ জানিয়েছিল যে ঐবছর মোট ৩৭টি বই ছাপা হয়েছিল ।

১৮৩৫এ ইংরাজরা প্রবর্তন করলেন একটি সাধারণ গ্রন্থাগার বা ‘পাবলিক লাইব্রেরী’ । এদেশীয় লোকেরাও পিছিয়ে রইলেন না , ১৮৩৯এর ফেব্রুয়ারিতে কিছু সদাশয় ধনী ব্যক্তির অর্থানুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত হল তাদের ‘সাধারণ গ্রন্থাগার’ । ঐবছর জুনের মধ্যেই সেই গ্রন্থাগারের পুস্তক সংখ্যা হয়েছিল ১৮হাজার ।
‘বটতলার সাহিত্য’ বলে একটা বিদ্রুপবাক্য আমাদের সাংস্কৃতিক মহলে খুব প্রচলিত । মোটা দাগের অ-পরিশীলিত বই-পত্র, পঞ্জিকাতেই যে বইপত্রের বিজ্ঞাপন থাকে । এই ‘বটতলা’র কোন ভৌগলিক সীমানা নেই । চিৎপুরের অলিগলি, গরাণহাটা, আহিরিটোলা, শোভাবাজারে ছাপাখানায় বাংলা বইএর মুদ্রন ও  বিপনন ব্যবস্থা প্রথম সুরু হয়েছিল বাংলা বই ছাপার সেই আদিপর্বে । ধর্মীয় বই এর সংখ্যাই বেশি থাকতো, তৎকালীন ‘বাবু কালচারে’র সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আদিরসাত্মক বই ছাপা হ’ত অনেক ।

রক্ষণশীল হিন্দুরা তখন ভাবতেও পারতনা যে ধর্মগ্রন্থ ছাপাখানার কাগজে ছাপা হয়ে ঘরে ঘরে পৌছাবে । কারণটা সম্ভবত এই ছিল যে ছাপার কাগজ বানাত অন্যধর্মের লোকেরা, কম্পোজিটর বা মেসিন চালানোর লোকেরা ব্রাহ্মণ ছিল না । ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বটতলারই প্রকাশক ছিলেন । ভবানী চরণ শ্রীমদভাগবত ছেপেছিলেন বিশুদ্ধ হিন্দু মতে, ব্রাহ্মণ কম্পোজিটর দিয়ে অক্ষর সাজিয়ে, গঙ্গাজল দিয়ে কালি বানিয়ে পুঁথির আকারে বইটি ছেপে ছিলেন । দাম ছিল ৪০টাকা । ছাপা বইএর আদি যুগে বইএর দাম একটু বেশি ছিল,কিন্তু পরের ২৫/৩০ বছরে বটতলার প্রকাশকরা বইএর দাম অনেক কমিয়ে দেয় প্রতিযোগিতার কারণে । যেমন মুকুন্দরামের ‘চন্ডীমঙ্গল কাব্য’ ১৮২৩এ প্রথম ছাপা হওয়ার সময় দাম ছিল ৬টাকা, ১৮৫৬ সালে ঐ বইই দ্বিতীয়বার ছাপার পর দাম হয় একটাকা মাত্র । কৃত্তিবাসী  রামায়ণের আদিপর্ব ১৮৩১এ ছাপার সময় দাম ছিল দুটাকা আর ১৮৫৬ সালে ছাপার সময় দাম হয় দু আনা । উনিশ শতকে বাংলার বুদ্ধির জাগরণে অসামান্য অবদান ছিল কলকাতার ছাপাখানা আর বটতলার গ্রন্থপ্রকাশ । তখনও আধুনিক সভ্যজীবনের প্রায় কিছুই ছিল না কলকাতায়, কিন্তু ছাপাখানা ছিল, বই ছিল । ১৮৩০ সাল – রামমোহন রায় তখও জীবিত আর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন বীরসিংহ গ্রাম থেকে এসে কলকাতার বড়বাজারে রাইমণি দেবীর গৃহে দশ বছরের বালক ।


[ তথ্যসূত্র - ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’/বিনয় ঘোষ , রামমোহন ও ততকালীন সমাজ ও সাহিত্য/প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এবং ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা (১ম খন্ড) / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ]

কথা কলকাতা - চার

কথা কলকাতা - ৪

ঊনিশ শতকের ‘নগর কলকাতা’ । জন্মের একশো বছর পেরিয়ে সামান্য হলেও শিক্ষার আলোকরেখা দেখতে পেয়েছে । এসে গেছে সংবাদ পত্র । ইংরেজ তার সাম্রাজ্য শাসনের স্বার্থে বাংলা বই লেখানো শুরু করলো । স্রীরামপুর থেকে ফোর্ট  উইলিয়ামে যোগ দিলেন পাদরি উইলিয়াম কেরি । ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা শেখানোর বই লেখার জন্য সাহায্য নিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের । কেরি সাহেব তাঁর মুন্সি রামরাম বসুকে দিয়ে লেখালেন ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’, গোলকনাথ শর্মা সংস্কৃত থেকে বাংলায় লিখলেন ‘হিতোপদেশ’, পন্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার লিখলেন ‘বত্রিশ সিংহাসন’ ও ‘রাজাবলী’ । সূচনা হল বাংলা গদ্য রচনার ধারাবাহিকতা ।

কলকাতার সমাজ তখন এক কদর্য বিলাসিতা আর বেলেল্লাপনার প্রতিভু । সারা বাংলার কৃষককে নিঃস্ব করে বেড়ে উঠলো নগর কলকাতার জৌলুশ । ব্রিটিশরা জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতো । আর কলকাতায় থাকা জমিদার তার নায়েব, গোমস্তা, তালুকদার মারফৎ দরিদ্র কৃষকের কাছ থেকে তার বহুগুন বেশি আদায় করতো । ফলে বাংলার কৃষক নিঃস্ব ক্ষেতমজুরে পরিনত হল। জমির ওপর তার কোন অধিকার থাকলো না । তার জন্ম ঋণের মধ্যে, জীবন যাপন ঋণের বোঝা নিয়ে, তার মৃত্যুও ঋণের মধ্যে । অঠেরো শতকটা ছিল বেনিয়া, মুৎসুদ্দিদের যুগ আর উনিশ শতকে দেখা দিল জমিদার শ্রেণীর প্রাধান্য । ইংরাজ কোম্পানির সঙ্গে বেনিয়া, মুৎসুদ্দিগিরি, ব্যবসা করে যে বাঙ্গালিরা প্রভুত ধন সঞ্চয় করেছিল তারা ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে সেই অর্থে জমিমিদারি কিনে কলকাতায় অলস, বিলাসী জীবনে ভাসলো আর কলকাতার জৌলুশে আকর্ষিত হয়ে মারোয়াড়ি, গুজরাতি ব্যবসায়ীদের কলকাতায় আগমন শুরু হ’ল ।  বড় লাটের থাকার জন্য লাটভবন তৈরী হল ১৮০৪এ ১৩ লক্ষ টাকা ব্যয় করে । ১৮১৩তে টাউন হল তৈরী হ’ল ৭ লক্ষ টাকা খরচ করে । সারা বাংলার লুন্ঠিত সম্পদে কলকাতার জৌলুশ বাড়তে থাকলো । ক্লাইভ প্রথম মুর্শিদাবাদ শহর দেখে বলেছিল লন্ডন শহর মুর্শিদাবাদের ধারে কাছে আসতে পারবে না । সেই মুর্শিদাবাদ তার পুরানো গৌরব হারাল, জলকাতার চেয়ে অনেক পুরাতন ও সমৃদ্ধশালী শহর ঢাকা হয়ে গেল উপেক্ষিত মফঃস্বল, ‘নগর কলকাতা’ হয়ে উঠলো বাংলার এক ও অদ্বিতীয় শহর । ১৮১৩তে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বানিজ্যের অধিকার রদ করা হল, শুরু হ’ল  কলকাতায় অন্য ইউরোপীয় বানিজ্য প্রতিষ্ঠানের আগমন ।

কলকাতার রাস্তাঘাট, শহর উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য ইংরেজরা লটারি করে টাকা তোলার বন্দোবস্ত করেছিল । লটারির টাকাতেই টাউন হল তৈরী হয়েছিল । ১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ পর্যন্ত ২০ বছর এই লটারি কমিটি কাজ করার পর ইংলন্ডের কর্তাদের বোধদয় হয় যে, শহর উন্নয়নের জন্য লটারি করে টাকা তোলা গর্হিত কাজ । লটারি কমিটি বন্ধ হয়ে যায় । ১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ পর্যন্ত লটারি কমিটি কলকাতায় যে রাস্তাগুলি তৈরী করেছিল সেগুলি হ’ল – ইলিয়ট রোড, স্ট্র্যান্ড রোড (প্রিন্সেপ ঘাট থেকে হাটখোলা পর্যন্ত),উড স্ট্রীট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট, কর্নোয়ালিশ স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট,ওয়েলিংডন স্ট্রীট, হেস্টিংস স্ট্রীট, ময়রা স্ট্রীট,লাউডন স্ট্রীট, আমহার্স্ট স্ট্রীট, হেয়ার স্ট্রীট, কলুটোলা স্ট্রীট, মির্জাপুর স্ট্রীট, ক্যানাল স্ট্রীট, হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রীট ও রডন স্ট্রীট ।

লটারি কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল কলকাতার রাস্তা তৈরী করতে প্রত্যেক বছরে প্রয়োজন ১২০লক্ষ ইটের । ইট ভাঙ্গা খোয়া দিয়েই রাস্তা পাকা করা হ’ত । খোয়া ভাঙ্গার খরচ চিল ৮০ লক্ষ ইটের জন্য ৪৪৪৫টাকা । সেই সময় একজন মজুর ৩৬০০ ইট ভেঙ্গে খোয়া তৈরী করার মজুরি পেত ২টাকা মাত্র । অন্যদিকে কলকাতার বাবুরা লাখলাখ টাকা ওড়াত বাইজী নাচ, রক্ষিতা আর গণিকা পোষার পেছনে । কি হৃদয়হীন বৈপরীত্য ! ১৯২৪সাল পর্যন্ত খোয়ার রাস্তাই ছিল কলকাতার পাকা রাস্তা । পিচের রাস্তা করা শুরু হয়েছে ‘নগর কলকাতা’র জন্মের সোয়া দুশো বছর পর ১৯২৪ থেকে ।

১৮১৫তে তাঁর ৪২ বছর বয়সে স্থায়ি ভাবে বাস করতে কলকাতায় এলেন রামমোহন রায় – ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ । প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আত্মীয় সভা’ মাণিকতলা উদ্যান গৃহে । ইতিমধ্যে ১৮০০ সনে এক জনকল্যানকামী ও শিক্ষানুরাগী স্কটিশ ডেভিড হেয়ার ভারতে এসেছেন । এসেছিলেন সামান্য এক ঘড়ি নির্মাণ ব্যবসায়ী হয়ে । দেশীয় মানুষের অশিক্ষা আর নানান দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করে তাঁর মানসিক পরিবর্তন হয়েছিল, যোগাযোগ হয় রামমোহন রায়ের সঙ্গে । রামমোহন রায় ও রাধাকান্ত দেবের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দু কলেজ ২০শে জানুয়ারি ১৮১৭তে (এখন যা ‘প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে বিশ্বখ্যাত) । ঐ বছরেই তাঁর উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি এবং পরের বছর ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ । আরো কয়েকটি স্কুল ও একটি দেশীয় মেয়েদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন এই মহান শিক্ষাব্রতী । হিন্দু কলেজ ও ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার ফলে এক আধুনিক যুগের সূচনা হ’ল, কলকাতার সমাজে দেখা দিল নতুন জাগরণ । ডেভিড হেয়ার ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন না এই অভিযোগে খৃষ্টান মিশনারিদের কবরখানায় তাঁর মৃতদেহ যায়গা পায়নি । হেয়ারকে সমাধিস্থ করা হয় হেয়ার স্কুলের জন্য দেওয়া তাঁরই জমিতে ।

রক্ষণশীল হিন্দুদের প্রবল বাধা, এমনকি দৈহিক আক্রমণকে অগ্রাহ্য করে রামমোহন শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে ও সামাজিক কূপ্রথার বিরুদ্ধে জনচেতনা জাগ্রত করতে নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন । ওদিকে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করলেন ‘সমাচার দর্পণ’ ১৮১৮তে, যে পত্রিকার কথা েই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি । কলকাতায় অতয়েব বাংলা সংবাদপত্রে ঢেউ পৌছে গেল । রামমোহন রায় বের করলেন বাংলা সংবাদ পত্র ‘সম্বাদ কৌমুদি’(১৮২১) ও ফারসি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল–আখবর’(১৮২২) । দেশীয় সংবাদ পত্রের প্রসারে প্রমাদ গুনল ইংরেজ শাসন । তারা দেশীয়ভাষায় সংবাদ প্রকাশের পাঁচ বছরের মধ্যেই জারি করে দিল ‘ভার্নাকুলার প্রেস এক্ট’ বা ‘দেশীয় সংবাদ পত্র নিয়ন্ত্রণ আইন’ ১৮২৩এ । সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধে রামমোহন কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সহ প্রতিবাদ পত্র পাঠালেন বৃটেনের রাজার কাছে । প্রতিবাদ পত্রে রামমোহন বৃটিশ সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন েই বলে ‘পৃথিবীর কোথাও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য বিপ্লব ঘটেনি । বরং সংবাদপত্র দমন করলেই দেখা দিয়েছে বিক্ষোভ ও রাষ্ট্র বিপ্লব’ । ইংরাজ শাসনের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে কলকাতা সেই প্রথম প্রতিবাদী কন্ঠ শুনলো রামমোহনের মধ্যে । ইংলন্ডের রাজা রামমোহনের আর্জিতে কর্ণপাত করেনি । প্রতিবাদে রামমোহন তাঁর ফার্সি ভাষার সংবাদপত্র মিরাৎ-উল আখবর’এর প্রকাশ বন্ধ করে দিলেন । সংবাদপত্রটির শেষ সংখ্যায় রামমোহন একটি ফার্সি বয়াৎ ছাপালেন বাংলায় যার অর্থ “যে সম্মান হৃদয়ের শত রক্তবিন্দুর বিনিময়ে কেনা, হে মহাশয়, কোন অনুগ্রহের আশায় তাকে দারোয়ানের কাছে বিক্রি করো না” । চার্লস মেটকাফে অস্থায়ী বড়লাট হয়ে এসে ‘দেশীয় সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন’ রদ করেন ১৮৩৫এর অগস্টে । রামমোন তা দেখে যেতে পারেননি । ১৮৩৩এ লন্ডনে তাঁর মৃত্যু হয় । কিন্তু একটা চেতনাহীন সমাজে অশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের অচলায়তনে ভিতটা নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন মাত্র পনেরো বছরের কলকাতা বাসের জীবনে, পরের প্রজন্ম তাঁর দেখানো পথেই অগ্রসর হবে, এটা স্থির হয়ে গেল ।

রামমোহন রায় কলকাতায় স্থায়ী ভাবে আসার আগে কলকাতার এন্টালির পদ্মপুকুর অঞ্চলের এক অ্যালো ইন্ডিয়ান পরিবারে  জন্মগ্রহণ করল এক শিশু । হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও । কলকাতার তরুণ প্রজন্ম তখন হাজার বছরের চেতনাহীন সমাজে মুক্ত চিন্তার আলোকরেখার সন্ধান পেয়েছে । সতেরো বছর বয়সে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে ইংরাজি সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক রূপে যোগ দিলেন । মাত্র ২০জন ছাত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠা ১৮১৭সালে হয়েছিল হিন্দু কলেজের, ডিরোজিওর শিক্ষকতাকালে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে হ’ল ৪০২জন । ডিরোজিওর ছাত্ররা পুরাতন সংস্কার, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস বিসর্জন দিয়ে জ্ঞানের আলোতে বুদ্ধির মুক্তি আর চিন্তার স্বাধীনতায় তখন তারা উদ্ভাসিত । নতুন চিন্তার হাওয়া বইতে লাগল নগর কলকাতায় ।




কথা কলকাতা - তিন

কথা কলকাতা – ৩

কলকাতায় গড়ে উঠলো এক বেলাগাম দূর্নীতি আর বেলেল্লাপনার, মূল্যবোধহীন এক বিচিত্র সমাজ । অন্ধকারের উৎস থেকেই আলোক রেখার উতসার, আমরা জানি । ১৭৮০র জানুয়ারিতে জেমস অগস্টাস হিকি কলকাতায় একটা ছাপাখানা বসালেন আর ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে চার পৃষ্ঠার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করলেন । সেটিই দেশের প্রথম সংবাদ পত্র । হিকির পত্রিকায় হেস্টিংস ও কোম্পানীর কর্মচারীদের নানান দূর্নীতি ও কূকর্মের সংবাদ প্রকাশ হতে থাকল । হেস্টিংস হিকিকে জেলে ভরলেন, দুবছর চলার পর হিকির বেঙ্গল গেজেট বন্ধ হয়ে গেল । হিকির পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও, প্রায় একই সময়ে ইন্ডিয়া গেজেট, ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পমুখ পত্রিকার প্রকাশনা কলকাতার সমাজে এক নতুন মাত্রা যোগ করলো ।  

হেসটিংস জমানার হাজার দূর্নীতি ও কূকীর্তির মধ্যেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়েছিল । তখনকার কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি উইলিয়াম জোনসের উদ্যগে প্রাচ্য জ্ঞান-বিদ্যা চর্চা কেন্দ্র – ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠা ১৭৮৪তে আর সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের সাহায্য নিয়ে হলহেড সাহেবের লেখা ইংরাজি ভাষায় বাংলা ব্যকরণ রচনা ‘এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ । এই বইতেই প্রথম বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হল । বাংলা হরফ কেটে দিয়েছিলেন পঞ্চানন কর্মকার । তাঁকেই বাংলা হরফের জনক বলা হয় ।

ছাপাখানার বিস্তারের সঙ্গে আমাদের মানসিক বিকাশের সম্পর্ক গভীর ভাবে জড়িত, তাই এদেশে ছাপাখানা আসার ও বিস্তারের কাহিনিটা সংক্ষেপে বলে রাখি । জার্মানিতে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রন যন্ত্র প্রবর্তন (আবিষ্কার) করেন ১৪৫০এ । ভারতে পর্তুগীজরা ১৫৫৬ সনে, যে বছর আকবর মুঘল বাদশাহ হলেন, সেই বছর‌ গোয়াতে ছাপাখানা নিয়ে আসে ক্যাথলিক খৃষ্টানি বই ছাপার জন্য  । ভারতীয় ভাষায় সবচেয়ে পুরাতন ছাপার নমুনা পাওয়া গেছে কেরলে, তামিল ভাষায় অনুদিত খৃষ্টান ধর্ম বিষয়ক । ইংরেজরা এদেশে প্রথম ছাপাখানা বসায় এর দুশো বছর পরে, ১৭৭২এ মাদ্রাজে, আর বাংলায় হুগলীতে এন্ড্রুজ নামে এক সাহেব ছাপাখানা বসায় ১৭৭৮এ । এখান থেকেই হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অফ বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ ছাপানো হয় । পরের বছর ১৭৭৯এ হেসটিংসের আমলে কলকাতায় সরকারি ছাপাখানা বা ‘অফিসিয়াল প্রিন্টিং প্রেস’ স্থাপিত হয় । ছাপাখানা এসে যাওয়া মানে সমজ চর্চা ও জ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়া । এ দেশ সম্পর্কে বিদেশের মানুষ নানান সংবাদ জানতে পারলো, এ দেশ সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেল, ইংরেজদের নানান কুকীর্তি, দূর্নীতি, যথেচ্ছাচারের কথাও লোকে বেশি করে জানতে পারল । ১৭৮৯তে ফরাসি বিপ্লবে স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ বিশ্বের শিক্ষিত মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলেছে, আর এদেশে তখন ইংরেজ তার শাসন বন্দোবস্তকে আরো কঠোর করতে চাইছে । অতয়েব সংবাদ পত্রের সমালোচনা বন্ধ করার নানান ফন্দিফিকির খুঁজছে তারা ।
১৭৯৩এ কর্নওয়ালিশ বড়লাট হয়ে এসে চালু করলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত । নির্দিষ্ট দিনে খাজনা না মেটানোয় অনেক বনেদি জমিদারি নিলামে চড়লো, তৈরি হল ভুমি সম্পর্কহীন নতুন মধ্যশ্রেনী ইংরেজ শাসনের সহযোগী রূপে । কলকাতার জনসংখ্যা বাড়ল । ১৭৯৪এ কলকাতার রাস্তাগুলো ইটের খোয়া দিয়ে পাকা করার ব্যবস্থা হল কারণ, গাড়ি ঘোড়ার সংখ্যা বেড়েছে ইতিমধ্যে । গাড়ি বলতে পালকি আর ঘোড়ার গাড়ি । বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ঘোড়ার গাড়ি কেনেন নবকৃষ্ণ দেব । একটা পালকি টানতে লাগত পাঁচজন পালকিবাহক । ১৭৯০-৯৫এদের সারাদিনের মজুরি চিল পাঁচজনে মিলে একটাকা । একদিকে ইংরজ কর্মচারীদের আর তাদের দোসর এদেশীয় ‘বাবু’দের সীমাহীন বিলাস বৈভব অন্যদিকে সাধারণ শ্রমজীবিদের অসীম দারিদ্র !

ইউরোপীয় সাহেবরা তখন দু একজন বাংলা শিখছে অল্পবিস্তর । একজন রুশ পর্যটক গোলকনাথ দাস নামে একজনের কাছে বাংলা ভাষা শিখে বাংলা ভাষাতে একটা নাটক (প্রহসন) বাংলায় অনুবাদ করে ফেললেল ১৭৯৫এ এবং এখনকার এজরা স্ট্রীটের কাছে ডুমটোলায় অস্থায়ী মাচা বেঁধে এদেশীয় লোকেদের দিয়ে গনিকালয় থেকে মহিলা সংগ্রহ করে, ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করে নাট্যাভিনয়  করালেন । কলকাতা সেই প্রথম বাংলা নাটক দেখলো ।

১৭৯৮এ ওয়েলেসলি বড়লাট হয়ে এলেন । কলকাতায় ইংরেজ শাসন পোক্ত হলেও সারা ভারত তখনও তাদের তাঁবে আসেনি । দাক্ষিণাত্যে হায়দার আলি সঙ্গে যুদ্ধে ইংরাজ পর্যুদস্ত হয়েছিল । পরে হায়দারের পুত্র টিপু সুলতান ফরাসিদের সাহায্য নিয়েও পরাজিত ও নিহত হন । ওয়েলেসলি টিপুর নাবালক পুত্রকে নির্বাসিত করে কলকাতায় নিয়ে আসেন । সংবাদপত্রের সমালোচনা ওয়েলেসলির খুবই না-পসন্দ ছিল । তখন কলকাতা থেকে সাতটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হত । ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘মর্নিং পোষ্ট’, ‘টেলিগ্রাফ’, ‘ক্যালকাটা ক্যুরিয়র’, ‘ওরিয়েন্টাল ষ্টার’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট, ও ‘এশিয়াটিক মিরর’ । সবই ইংরাজদের মালিকানায় । বাংলা ভাষায় তখনও কোন সংবাদ পত্র প্রকাশ শুরু হয়নি, সেই মানসিকতাও গড়ে ওঠেনি তখনকার বাঙ্গালিদের মধ্যে । যুদ্ধ করে রাজ্য দখলের সমালোচনা প্রকাশ হচ্ছিল সংবাদপত্রগুলিতে । সরকারের সমালোচনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওয়েলেসলি জারি করল ‘সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্স’। এদেশে সেই প্রথম সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ,  তাও এদেশে সংবাদপত্রের উদ্ভবের মাত্র কুড়িবছরের মধ্যেই ।
উনিশ শতকের শুরুতেই কলকাতার ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা শেখানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’ ১৮০১এ ।
                                                                          ( চলবে ...)



কথা কলকাতা - দুই

কথা কলকাতা – ২

সভ্যতার গর্ব করা ইংরাজ কোম্পানীর কর্মচারীদের দুর্নীতি আর তাদের দেশীয় সহযোগী বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের কৃতকর্মের কলঙ্কের কাদা সর্বাঙ্গে মেখে শুরু হয়েছিল নগর কলকাতার শৈশব । পলাশীর যুদ্ধজয় আর সিরাজদৌল্লাকে গুপ্ত হত্যার পর ক্লাইভরা মুর্শিদাবাদে নবাবের কোষাগার লুঠ করেছিল । কোষাগারে ছিল এক কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ রুপোর টাকা,বত্রিশ লক্ষ সোনার মোহর,দুই সিন্দুক ভর্তি সোনা,চার বাক্স হীরা জহরত, দুই বাকস চূণী পান্না এবং আরো অন্যান্য মূল্যবান রত্ন । ক্লাইভ নীজে লুঠের বখরা পেয়েছিল ২৩লক্ষ২৪হাজার টাকা । একশ নৌকা বোঝাই হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে লুঠের টাকা কলকাতায় আসে । সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ক্ষতিপুরনের এককোটি টাকা আসে ২৭টি নৌকা বোঝাই হয়ে । কোম্পানীর সহযোগী দেশীয় বেনিয়ারাও লুঠের বখরা পেয়েছিল । সেই সময়ে এই পরিমান অর্থের মূল্যমান কত ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায় । সেই সময় কুমারটুলি অঞ্চলে এককাঠা জমির দাম ছিল ১১টাকা ।
নবাবের কোষাগার লুঠের টাকায় কলকাতার সমৃদ্ধির সূচনা হল । সমৃদ্ধি মানে ক্লাইভের মত অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত কোম্পানীর কর্মচারীরা আর তাদের দালাল বেনিয়ারা নবাব হয়ে গেল । ঘুষ, উতকোচ, দূর্নীতি, বেলেল্লাপনার চূড়ান্তরূপ কলকাতা দেখেছিল তার শৈশবেই ।  সূচনা হল অর্থলোভী এক নতুন সমাজ – নতুন বণিক সভ্যতা । শৈশবে পিতৃহীন নবকৃষ্ণ দেব ক্লাইভের সামান্য মুন্সী ছিলেন । সিরাজদৌল্লারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে মীরজাফর – ক্লাইভের বিশ্বস্ত সহযোগী হয়েছিলেন । লুঠের মোটা বখরা পেলেন । নকৃষ্ণ হেস্টিংসকে ফার্সি, উর্দু ভাষা শেখাতেন । হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর সমস্ত সুতানুটির (এখনকার উত্তর কলকাতা) তালুকদারী পেয়ে গেলেন নকৃষ্ণ । মুঘল বাদশাহর কাছ থেকে মহারাজা খেতাবও আনিয়ে দিলেন হেস্টিংস । হঠাত ধনি এই দেশীয় বেনিয়া মুতসুদ্দিদের দ্বারা পরিপোষিত দূর্নীতি, বেলেল্লাপনার বাবু সংস্কৃতির সেই শুরু । ১৭৭০এর মন্বন্তরে গোটা বাংলার একতৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুতেও কলকাতার এই নতুন নাগরিক সমাজের কোন হেলদোল হয় নি । শোনা যায়, নবকৃষ্ণ দেব তার মায়ের শ্রাদ্ধতে দশ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন ।
মহারাজ নন্দকুমার হেস্টিংসের দূর্নীতি, উৎকোচ নেওয়ার কথা জেনেছিলেন, অতয়েব মিথ্যা মামলা সাজিয়ে নন্দকুমারের মত উচ্চ পদমর্যাদার মানুষকে ফাঁসিতে লটকে দিল (৫ই অগস্ট ১৭৭৫) । নগর কলকাতা দেশের প্রথম ফাঁসি দেখলো (কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৭৭৩এ) । কয়েক হাজার মানুষ গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য নাকি দেখেছিলেন ।
তখনও কলকাতায় ছাপাখানা আসেনি, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়নি । ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন প্রত্যন্ত হুগলীর খানাকুলে মাতৃক্রোড়ে তিন বছরের শিশু । ছাপাখানা এল ১৭৮০তে, ছাপাখানা বসালেন জেমস অগস্টাস হিকি ।                                                  ( চলবে ...)


তথ্যসূত্র - ‘কলকাতা তিনশতক’ /কৃষ্ণ ধর এবং কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (২য় খন্ড)’ / বিনয় ঘোষ ।

কথা কলকাতা - এক

কথা কলকাতা - ১

১৬৯৮  খৃষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে তিনটি গ্রাম সুতানুটি,কলকাতা গোবিন্দপুর কিনে নিয়েছিল ১৩০০টাকার বিনিময়ে । ‘শহর কলকাতা’র পথচলা অতয়েব শুরু হয়েছিল সেদিন থেকে । কিন্তু প্রকৃত অর্থে কলকাতার নগরায়ন শুরু হয় পলাশির যুদ্ধের পরে (১৭৫৬) । নতুন একটা শহরের পত্তন তো হ’ল, কিন্তু কেমন ছিল সেই আদি কলকাতার চেহারাটা ? কলকাতা পত্তনের ১৬ বছর পরে অর্থাৎ ১৭০৬ খৃষ্টাব্দে যে তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা হ’ল, সেই তিনটি গ্রামের জমি,বাড়ি রাস্তা ইত্যাদির একটা জরীপ হয়েছিল । সেই জরিপ অনুযায়ী  সাবেক কলকাতার অবস্থা ছিল এই রকম –
সুতানুটি - মোট জমি ১৬৯২ বিঘা । তারমধ্যে ১৫৫৮বিঘা ছিল জঙ্গল ও ধানক্ষেত । গোবিন্দপুর – মোট জমি ১১৭৮ বিঘা । তারমধ্যে ১১২১ বিঘা ছিল ঘোর জঙ্গল । কলকাতা -  দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল (১) বাজার কলকাতা – মোট জমি ৪৮৮ বিঘা, তারমধ্যে পতিত জমি চিল ৮৮ বিঘা । (২) ডিহি কলকাতার মোট ১৭৭৮ বিঘা জমির মধ্যে ১৪৭০ বিঘা ক্ষেত ও পতিত জমি । তো, তিনটি গ্রাম যা নিয়ে কলকাতা, তার মোট ৫০৭৬ বিঘা জমির মধ্যে ১৫২৫ বিঘা চিল ধানক্ষেত, ৪৮৬ বিঘায় ছিল বাগান । ঐ সনের জরিপ অনুযায়ী তখন মাত্র দুটি ‘স্ট্রীট’ ও দুটি ‘লেন’ ছিল ।
আরো ২০ বছর পরে দ্বিতীয় জরিপ হয়, তখন ‘স্ট্রীট’এর সংখ্যা হয় ৪, ‘লেন’ ৮ । আরো ১৬ বছর পরের, ১৭৪২এ তৃতীয় জরিপে দেখা যায় কলকাতার স্ট্রীটের সংখ্যা- ২৭, ‘লেন’- ৫২, বাইলেন-৭৪ । ১৭৫৬ পর্যন্ত কলকাতায় একটিও বড় রাস্তা বা’রোড’ ছিল না । ১৭৯৯এ কলকাতায় প্রথম চওড়া বড় রাস্তা হয় ‘সার্কুলার রোড’ – ইট ভাঙ্গা খোয়া দিয়ে । তখন থেকে কলকাতায় ঘোড়ার গাড়ি চলা শুরু হয় । তার আগে পর্যন্ত কলকাতায় স্থল যান বলতে ছিল মানুষ টানা পালকি ।
ঘোড়ার গাড়ির চল হওয়া শুরুহলেও তা ছিল সাহেবদের ব্যবহার্য । এদেশীয় মানুষ পালকিই ব্যবহার করতেন । ইউরোপীয়রাও পালকিতে যাতায়াত করত । জানা যায় ডেভিড হেয়ার কোনদিন ঘোড়ার গাড়ি চড়েন নি, বরাবর পালকি ব্যবহার করতেন । অভিজাত জমিদারদের নিজস্ব পালকি থাকতো, পালকি ভাড়াও পাওয়া যেত । পালকি বেহারা মাইনা পেত ৫টাকা মাসে । ভাড়া করা পালকির খরচ ছিল পালকি ও পাঁচ জন বেহারার মজুরি মিলিয়ে দিনে একটাকা চারআনা ।
কলকাতার নগরায়ন শুরু হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধের পর । কোম্পানীর শাসনের কাজ চালানোর জন্য যেটুকু তাদের দরকার চিল । মুর্শিদাবাদের নবাবের কোষাগার লুঠকরা অর্থে কোম্পানীর ছোট বড় সাহেবরা আর তাদের পদসেবা করা দেশী বেনিয়া, মুৎসুদ্দিরা যেন এক একজন নবাব হয়ে গেলেন, বিলাসীতায় গা ভাসালেন । কলকাতা বাড়তে আরম্ভ করলো উনিশ শতকের গোড়া থেকে ।

তথ্য সূত্র – কলিকাতা দর্পণ / রাধারমণ মিত্র