পাঠকের পছন্দ

Sunday, November 29, 2015

'কথা কলকাতা' - ৫, ৩০ নভেম্বর ২০১৫

আদি কলকাতায় বারাঙ্গনাবৃত্তির উদ্ভব ও বারাঙ্গনা কন্যাদের আলোয় ফেরার সংগ্রাম 
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

[প্রাক-কথন ইতিহাসের কৌতুহলী ছাত্র হিসাবে ১৮ ও ১৯ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাস আমার বিশেষ আগ্রহের জায়গা। সেই আগ্রহ থেকে বাংলার সামাজিক জীবনে বারাঙ্গনা সমস্যার উদ্ভব, বিকাশ ও তার প্রভাব সম্পর্কে বুঝতে চেয়েছি নানা আকর গ্রন্থ ও সেকালের সংবাদপত্রের সংকলিত প্রতিবেদন ঘাঁটাঘাঁটি করে। এই লেখা বাংলার সামাজিক ইতিহাসের কিছু তথ্য মাত্র]

নগরসভ্যতা আর পতিতাবৃত্তি প্রায় সমবয়সী। মধ্যযুগে নগরসভ্যতার অন্যতম ভূষণ ছিলো বারাঙ্গনা পল্লী। বারাঙ্গনা সংসর্গ ছিলো মধ্যযুগীয় পৌরুষ ও আভিজাত্যের প্রতীক। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। আমি বুঝতে চেয়েছি এদেশে আধুনিক নগরসভ্যতার বিকাশের ধারায় বারাঙ্গনা সমস্যার উদ্ভব ও তার সামাজিক প্রভাব।

         আধুনিক শহরের সমস্ত কদর্যতাকে সঙ্গে নিয়ে নগর কলকাতার ক্রমবিকাশ হয়েছে, আর এদেশে বারাঙ্গনাবৃত্তির উদ্ভব বৃটিশ শাসনের হাত ধরেই। কলকাতার নগরায়ন শুরু হয় পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে। সংবাদপত্র দূরের কথা, ছাপার যন্ত্রের কথাও তখন কল্পনায় ছিলো না। শৈশবের কলকাতায় লোকসংখ্যাই বা কত! ১৭১০ সালে কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি যে তিনটি গণ্ডগ্রাম নিয়ে কলকাতা নগরীর পত্তন হয়েছিলো, সাকুল্যে তার লোকসংখ্যা ছিলো দশ হাজার। ১৭৪০-৫০ সময়কালে বাংলার গ্রামে গ্রামে মারাঠা বর্গী হামলার ফলে আতঙ্কিত বহু মানুষ নিরাপত্তার জন্য কলকাতায় বসবাস শুরু করলো। ব্যবসা-বানিজ্যে ও নানা কারণে কলকাতার লোকসংখ্যা বাড়তে থাকলো। কলকাতা তার গ্রামীণ রূপ থেকে শহরে পরিণত হলো। ১৭৫২তে হলওয়েল সাহেবের হিসেব মতন কলকাতার লোকসংখ্যা ছিলো চার লক্ষ নয় হাজার।

        কলকাতায় বিচারালয় স্থাপনের পর অ্যাটর্নি হয়ে এসেছিলেন উইলিয়াম হিকি। নভেম্বর ১৭৭৭ থেকে ১৮০৮ পর্যন্ত হিকি কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফেরার পর চার খণ্ডে তাঁর যে স্মৃতিকথা (১৭৪৯-১৮০৯) লিখেছিলেন, সেটি শৈশবের কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত। স্মৃতিকথায় হিকি মিস ডানডাস নামে মহানগরের এক বহুজন পরিচিতা বারাঙ্গনার কথা উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে বারাঙ্গনা বৃত্তির সূচনা যে ইংরাজ আমলেই হয়েছিলো, তাতে কোনও সংশয় নেই।

          হিকি যে সময়ের কথা বলেছেন, তখন নগর কলকাতার নিতান্তই শৈশবকাল। কলকাতার নগরায়ন সবে ক্ষীণ গতিতে শুরু হয়েছে। কোম্পানীর কাজ-কর্ম চালানোর জন্য ইংরাজ ভাগ্যান্বেষীরা তাদের নতুন উপনিবেশে আসতে শুরু করেছে। কলকাতার সেই শৈশবে ভাগ্যান্বেষণে যে সব ইংরাজরা এসেছিলো, তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, উছৃঙ্খল। তাদের দোসর হলো ইংরাজ শাসনের প্রসাদলোভী বেনিয়ান, মুৎসুদ্দিরা। পালকি আর গোরুর গাড়ির যুগের সেই কলকাতায় দেশীয় খবরের কাগজ তো দূরস্থান, ছাপার অক্ষরেরও উদ্ভাবন হয়নি। কিন্তু বারবণিতা বৃত্তির প্রসার হয়েছিলো ভালোই। ১৭৯৫এ রুশ যুবক হেরাসিম লেবেদফ যখন কলকাতায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে প্রথম বাংলা থিয়েটারের সূচনা করলেন, তখন সেই নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বারবণিতা পল্লীর মেয়েদের নিয়োগ করেছিলেন। অর্থাৎ, ১৭৯৫এর অনেক আগে থেকেই বারাঙ্গনা পল্লীর অস্তিত্ব ছিলো। আর শুধু কলকাতা নয়, বাংলার সমৃদ্ধ শহরগুলি, যেখানে ইংরাজরা কোর্ট-কাছারি, দপ্তর খুলেছিলো, সেখানেই সন্নিহিত অঞ্চলে বারাঙ্গনা পল্লী গড়ে উঠেছিলো। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজগ্রন্থে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা) আত্মচরিত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কৃষ্ণনগরের সমকালীন সামাজিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র লিখেছেন, “...... পূর্বে কৃষ্ণনগরের কেবল আমিনবাজারে পতিতালয় ছিলো, গোয়াড়ীতে গোপ, মালো প্রভৃতি জাতির বাস ছিলো। পরে ইংরেজরা যখন এখানে বিচারালয় ইত্যাদি স্থাপন করেন, তখন গোয়াড়ীর পরিবর্তন হইতে থাকে।’’ কার্তিকেয়চন্দ্র আরো লিখেছেন, “...... বিদেশে পরিবার লইয়া যাইবার প্রথা অপ্রচলিত থাকাতে প্রায় সকল আমলা, উকিল বা মোক্তারের এক একটি উপপত্নী আবশ্যক হইত।সুতরাং তাহাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় সংস্থাপিত হইতে লাগিল।এই কারণেই আমরা দেখি উত্তর কলকাতায় প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত লোকবসতি কেন্দ্রের আশেপাশেই প্রাচীন গণিকাপল্লীগুলির অবস্থান।

         ১৭৯৩এ কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার গ্রাম-সমাজের কাঠামোটাই ভেঙ্গে দিলো। সূর্যাস্ত আইনের প্যাঁচে বনেদি জমিদাররা নিঃস্ব হলো, আর বেশি রাজস্ব দেবার অঙ্গীকারে নিলামে জমিদারি কিনে ভূমিসম্পর্কহীন এক অর্থলোলুপ মধ্যশ্রেণীর উদ্ভব হলো। দুর্ণীতিগ্রস্ত, উছৃঙ্খল ইংরেজ আর শিকড়হীন নতুন মধ্যশ্রেণীটির পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম নিলো এক কুৎসিত সংস্কৃতি - যাকে আমরা বাবু কালচারবলে জেনেছি। গড়ে উঠেছিলো ইংরাজের দালালি করা এক লোভী, দুর্নীতিপরায়ন, অলস নাগরিক সমাজ। আঠেরো শতকের কলকাতা ছিলো এদেশীয় দালাল, মুৎসুদ্দি, বেনিয়াদের কলকাতা আর উনিশ শতকে বাবুকলকাতা। আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজগ্রন্থে কলকাতার সেই বাবুসমাজের বর্ণনা দিয়েছেন এইরকম – “ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিছু বর্ণনা করিব? মুখে, ভ্রুপার্শ্বে ও নেত্রকোণে নৈশ অত্যাচারের চিহ্ন স্বরূপ কালিমারেখা। শিরে তরঙ্গায়িত বাবরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে কালোপেড়ে ধুতি। অঙ্গে উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে উত্তমরূপে চুনোট করা উড়ানী এবং পায়ে পুরু বাগলস সমন্বিত চিনাবাড়ির জুতা। এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া বুলবুলের লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাফ আখড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের মেলা, মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময় কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিয়া থাকিত।ইংরেজের শাসন-সহায়ক কদর্য বাবু সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বারাঙ্গনাপল্লীগুলো ফুলে ফেঁপে উঠলো গোটা উনিশ শতক জুড়ে। রক্ষিতা পোষণ, বারাঙ্গনাগমন তখনকার সমাজ শুধু অনুমোদনই করতোনা, এইসব বেলেল্লাপনা ছিলো তাদের মর্যাদার সূচক।
         
         ইংরাজের নতুন ভুমিব্যবস্থা গ্রাম্য সমাজকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিলো। ফলে বংশানুক্রমিক পেশা ও বৃত্তি থেকে উৎখাত হয়ে যেমন চোর ডাকাতের দল সৃষ্টি হয়ে শহরে আশ্রয় নিলো, তেমনই দারিদ্রের তাড়নায় শহরের বারাঙ্গনা পল্লীতে আশ্রয় নিলো মেয়েরা। ১৮৭২সালের সরকারী নথিপত্র থেকে জানা যায় যে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বারবনিতারা অধিকাংশই তাঁতি, তেলি, জেলে, কৈবর্ত, ময়রা, চামার, কামার, কুমোর, যুগী, গয়লা, নাপিত, মালি, বেদে ইত্যাদি (সূত্র – ‘অন্য কলকাতা’ / বিশ্বনাথ জোয়ারদার)। এই সময়ে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বারবনিতাদের সংখ্যা কি রকম লাফে লাফে বেড়েছিলো, তা জানা যায় এই তথ্য থেকে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ১৮৬৭র ১৬ই সেপ্টেম্বরের হিসাব মতন তিন হাজার মেয়ে এই বৃত্তিতে নিযুক্ত। ১৮৮০ সালের এক হিসাবে শহরে বারবনিতার সংখ্যা ছিলো সাত হাজার আর ১৮৯৩ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছিলো ২০,১১৬। (তথ্যসূত্র অন্য কলকাতা’ / বিশ্বনাথ জোয়ারদার )।

          ‘বাবু কলকাতারসেই কদর্য বেলেল্লাপনার ছবি এখন আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না। শহরের যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে বারাঙ্গনা পল্লী। সম্ভ্রান্ত এলাকা বা বিদ্যালয়ের পাশেও। বিত্তশালী বাবুদের প্রশ্রয়েই এইসব বারাঙ্গনাপল্লী গজিয়ে উঠেছিলো, তাই প্রশাসনের সাধ্য ছিলো না এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার। এইসব বাবুদের আদর্শ ছিলো ইংরাজ রাজকর্মচারীরা। শ্রীপান্থ তাঁর কলকাতাগ্রন্থে রোটি আউর বেটিরচনায় মন্তব্য করেছেন সতীদাহ কলকাতায় তখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। সারা ব্ল্যাক টাউন চিতার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চলছে বাবু বিলাস, গুরু-প্রসাদী কৌলীন্য রক্ষা। সতীর আর্তনাদে, বিধবার কান্না আর বারবনিতার কাতর আহ্বানে অষ্টাদশ শতকের কলকাতা প্রেতপুরী। পা যেন লজ্জায় জড়িয়ে আসে সেদিকে বাড়াতে।

         শুধু সমাজের নিম্নবর্গের মেয়েরাই নয়, কুলীন ঘরের বহু মেয়েও অবস্থার দুর্বিপাকে আশ্রয় নিতো বারাঙ্গনাপল্লীতে। সরকারী প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছিলো যে বারাঙ্গনাদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ হিন্দু বিধবাদের বারাঙ্গনা পল্লীতে আশ্রয়। বিধবাবিবাহ প্রথা চালু না হওয়ায় লালসার শিকার বিধবা তরুণীদের শেষ আশ্রয় ছিলো বারাঙ্গনা পল্লী। সরকারী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো হিন্দুর বিবাহ-বিচ্ছেদ নেই, বিধবা হলে হয় পবিত্র হও, নচেৎ বেশ্যা হও।সরকারী প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু বিধবারা প্রধানত হুগলী, বর্ধমান, হাওড়া, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা থেকে আসতেন। তরুণী বিধবারা বাবুদের লালসার শিকার হতেন, কেউকেউ গর্ভবতী হয়ে পড়তেন। তাঁদের আশ্রয় হত বেশ্যালয়ে। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, ইত্যাদি কারণে মা, মেয়ে দুজনেই আশ্রয় নিতো গণিকাপল্লীতে।মুহূর্তের ভুলে অন্তসত্বা নারী আত্মহত্যা না করে বাঁচার উপায় খুঁজেছেন বেশ্যালয়ে আশ্রয় নিয়ে, আবার বহুবিবাহের শিকার নারী প্রেমিকের হাত ধরে কুলত্যাগিনী হয়েছেন, অবশেষে এসে জুটেছেন বারাঙ্গনাপল্লীতে। গবেষক অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত সরকারী দস্তাবেজ উদ্ধার করে লিখেছেন সরকারী মহাফেজখানা থেকে যে রিপোর্ট পেয়েছি তা কৌতূহলোদ্দীপক। দেখা যায় দশ বছরের নিচে বেশ্যাদের বাড়িতে বেশ কিছু মেয়ে রয়েছে। সরকার এদের কথা মাঝে মাঝে ভেবেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত ব্যাপক যে সরকারের পক্ষে কিছু করে ওঠা কঠিন।সেই হিসাব মত, গণিকাপল্লীতে বারাঙ্গনা গর্ভজাত কন্যাসন্তানের সংখ্যা ছিলো ৪০৮ জন। এইসব বারাঙ্গনা কন্যাদের পুনর্বাসন বা সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তখনকার সরকার যেমন কিছু করতে পারেনি, তেমনই সমাজ সংস্কারকদেরও কোনও হেলদোল ছিলো, এমন তথ্যও জানা যায় না। তাঁরা নিজেরাই মুক্তির পথ বেছে নিলেন। এবং এই মুক্তির পথ দেখালো থিয়েটার, আর বারাঙ্গনা কন্যাদের থিয়েটারে নিযুক্তির পথ খুলে দিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

        বাংলা থিয়েটারের সবে শৈশবকাল। ১৮৭২এর ৬ই ডিসেম্বর সাধারণ মানুষের জন্য রঙ্গালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ধনকুবের আশুতোষ দেবের(ছাতুবাবু) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ বেঙ্গল থিয়েটারনামে থিয়েটার খুললেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁদের থিয়েটারের জন্য দুটি নাটক লিখে দিতে অনুরোধ করলেন। মধুসূদন সম্মত হলেন, কিন্তু একটি শর্তে, নাটকে স্ত্রী চরিত্রের রূপায়ণ মেয়েদের দিয়েই করাতে হবে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, সেইসময় বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ভালোভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিলো। উপদেষ্টা মণ্ডলীতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ। অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরি সভায় বিদ্যাসাগর বিরোধিতা করলেন থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের। উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদনের সমর্থন পেয়ে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের মত মানুষের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে বারাঙ্গনাপল্লী থেকে চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন। ১৮৭২এর ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার তার যাত্রা শুরু করলো। সে ছিলো এক যুগান্তকারী ঘটনা। মাইকেল অবশ্য এই দিনটাকে দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই তাঁর দেহাবসান হয় (২৯শে জুন ১৮৭৩)।

         মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন। তাঁদের একটা তাগিদ ছিলো মুক্তির তাগিদ। থিয়েটারকে তাই তাঁরা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, এই পথ ধরেই থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী,কুসুমকুমারী, নীহারবালা, কৃষ্ণভামিনী প্রভাদেবীরা। বস্তুত, নাট্যাভিনয়ে তাঁদের যোগদানের কারণেই বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিলো। পরবর্তী সত্তর/আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন অন্ধকার জগৎ থেকে আসা এই মহিলারাই।

         থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অতএব দেড়শো বছরের ক্লেদাক্ত অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম শুরু করলেন পিতৃপরিচয়হীনা বারাঙ্গনা কন্যারা। সে দিনের সমাজ যে তাদের সঙ্গে ছিলো তা নয়। এ ছিলো প্রবল শক্তিধর সমাজের সঙ্গে তাদের অসম লড়াই। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ তাদের অলোয় ফেরার সংগ্রামে সঙ্গ দিয়েছিলেন সেকালের সংবাদপত্র ও সমাজপতিদের লাগাতার বিরোধিতা ও নিন্দাবাদ সত্ত্বেও। সেইসব সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে গিরিশচন্দ্রের প্রশ্ন ছিলো এই সব মেয়েদের তো আমি অন্তত রাস্তায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার পাকড়াবার চেষ্টা থেকে সরিয়ে, মঞ্চে তুলে দিয়ে রোজগারের একটা পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তোমরা এদের জন্য কি করেছো?” পঙ্কজা থেকে মহীয়সী হয়ে ওঠা বারাঙ্গনাকন্যাদের অনেকেই আমাদের বিনোদন শিল্প তো বটেই, সাহিত্যে ও এবং সামাজিক ইতিহাসেও অতুল কীর্তি রেখে গেছেন। আমাদের সমাজ এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় নি, দিতে চায় নি।

         কেমন করে সমাজের গভীর অন্ধকার স্তর থেকে উঠে আসা এক অসহায়া নারী বিনোদিনী তাঁর তন্ময় সাধনায় দুরূহ সিদ্ধি আয়ত্ব করেছিলেন, স্থায়ী রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং খ্যাতির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেও নীরবে মঞ্চের অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বঞ্চনার শিকার হয়ে মাত্র তেইশ বছর বয়সে, তা ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। রঙ্গালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের ছাব্বিশ বছর পরে, ৪৯ বছর বয়সে, বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী আমার কথাগ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। তার আগে এবং পরেও বিনোদিনীর লেখনিচর্চা অব্যাহত ছিলো। প্রকাশ করেছিলেন এবংবাসনাএবং কনক ও নলিনীনামে দুটি কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা কিংবা দুটি কাব্যগ্রন্থের লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী পান নি। বারারাঙ্গনা কুলোদ্ভবা যে! এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ শিশুকন্যা সহ বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন, সমাজের মানী লোকেরা, যারা তাঁর অভিনয় দেখার জন্য রাতের পর রাত প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যেতেন, তাঁকে ধন্যধন্য করতেন, তাঁরা বিনোদিনীর কন্যাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে দেন নি, বাধা দিয়েছিলেন। বিনোদিনী পারেননি তার কন্যা শকুন্তলাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে। শকুন্তলাকে বাঁচাতে পারেন নি বিনোদিনী, ১৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।

        বিনোদিনী পারেন নি। গোলাপসুন্দরী পেরেছিলেন। এক মহতী হৃদয় মানুষের, বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস গোলাপের বিবাহ দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে। তাঁরা ভদ্রপল্লীতে বাসা বেঁধে ছিলেন। এক কন্যার জন্মের পর গোলাপ স্বামী পরিত্যক্তা হন। গোলাপ তখন স্বনামে সুকুমারী দত্ত। মেয়েকে মানুষ করার জন্য গোলাপ থিয়েটারও ছেড়েছিলেন বেশ কয়েক বছর। সুকুমারী কিন্তু থেমে থাকেন নি। গোষ্ঠবিহারী তাঁকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়লেন। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুলে। কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারলেন না। ন্যাশনাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নাটক করলেন। ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অর্থকষ্ট সামাল দিতে সুকুমারী নাট্যরচনায় মন দিলেন, নিজের ব্যক্তিজীবন ও নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে রচনা করলেন অপূর্ব সতীনামে একটি নাটক। নাটকটি অভিনীতও হয়েছিলো। বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস সুকুমারীকে প্রথম মহিলা নাট্যকারের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে। মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, প্রচুর অর্থব্যয় করে তার বিবাহ দিয়েছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। যদিও মেয়েকে দেখার জন্য তার শ্বশুর গৃহে প্রবেশের অধিকার তাঁকে ত্যাগ করতে হয়েছিলো।

       অভিনেত্রী কৃষ্ণভামিনী মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তি উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষাবিস্তারের কাজে ও দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসার কাজে। কৃষ্ণভামিনীরা ইতিহাস নির্মাণ করেন কিন্তু ঐতিহাসিকের সম্মান অর্জন করেন না, এমনই পরিহাস! বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় লিখেছিলেন নারীর নিস্তার নাই টলিলে চরণ। দেড়শো বছর পরে আজকের সমাজ অনেক আলোকপ্রাপ্ত। তথাপি সংশয় জাগে, বিনোদিনীর এই কথাটা কি আজও পুরোপুরি মিথ্যা হতে পেরেছে ?

তথ্যসূত্র – ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ / বিনয় ঘোষ, ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’ / অমিত মৈত্র, সুকুমারী দত্তর অপূর্ব সতীনাটকের ভুমিকা / ড.বিজিতকুমার দত্ত (নাট্য আকাদেমি পত্রিকা, জানুয়ারি ১৯৯২, ‘অন্য কলকাতা’ /বিশ্বনাথ জোয়ারদার, ‘কলকাতা’ / শ্রীপান্থ।



Wednesday, September 23, 2015

কথা কলকাতাঃগোরুর গাড়ি থেকে জেটযুগ

কলকাতার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা : গোরুর গাড়ি থেকে জেট যুগ

আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্য ইতিহাসের পাতা ভর্তি হয়েছে রাজা-রাজড়াদের উথ্বান-পতন আর যুদ্ধ, খুন ও ষড়যন্ত্রের কাহিনি দিয়ে । সেখানে সামাজিক ইতিহাসের উপাদান খুজে পাওয়া যায় না ।  বেশি দিন আগের কথা বলছি না । তিনশ’ বছর আগেও মানুষ দূর পথে যাতায়াত করতো কি ভাবে ? জানতে কৌতুহল হয় । সর্বকালে, সর্বদেশেই মানুষের দুটি পা ভিন্ন তার যাতায়াতের আদিমতম উপায় ছিল নদীপথ । দুশ’ বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর আট বছর বয়সে পিতার সঙ্গে বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতা এসেছিলেন হাঁটাপথে । আরো পনেরো বছর পরে ১৮৪৩এ জর্জ এভারেস্ট, যার নামে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম, দেরাদুন থেকে বরাবর নদীপথে কলকাতা এসেছিলেন । সময় লেগেছিল ৩৫ দিন । তারও পনেরো বছর পরে ১৮৫৬তে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে কাশী গিয়েছিলেন নদীপথে নৌকায় । যদিও তখন অল্প-বিস্তর রেল লাইন পাতা শুরু হয়েছিল । সময় লেগেছিল দেড় মাস আর নৌকা ভাড়া লেগেছিল একশ’ টাকা । কিন্তু হাঁটাপথ বা নদীপথ নয়, আমি বলবো কলকাতার সড়কপথে যাতায়াতের কথা, সড়ক পরিবহন বন্দোবস্তের বেড়ে ওঠার কথা ।

আমরা চলতি কথাবার্তায় একটা জমজ শব্দ প্রায়ই বলি ‘গাড়ি-ঘোড়া’ । যেমন, হরতালের দিন রাস্তাঘাট শুনসান, ‘গাড়ি-ঘোড়া’র দেখা নেই – এই রকম । কথায় ঘোড়ার আগে গাড়ি থাকলেও আসলে কিন্তু গাড়ির অনেক আগে ঘোড়া এসেছে । মানুষ বা মালপত্র বইবার জন্য পশুশক্তির ব্যবহার হয়ে আসছে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই । এখনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাল পরিবহনতো বটেই মানুষ পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ির ব্যবহার হয় ।  এখন এই আধুনিক জেট-গতির যুগে বিস্ময়কর লাগে, প্রায় দেড়শ বছর আগে ১৮৭৮এর সেপ্টেম্বর মাসে স্বামী বিবেকানন্দের মা ভুবনমোহিনী বালক নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে বাগবাজার থেকে মধ্যপ্রদেশের (এখন ছত্তিশগড়) রায়পুরে গিয়েছিলেন গোরুর গাড়িতে চেপে । রায়পুরের দূরত্ব প্রায় সাড়ে আটশ’ কিলোমিটার । বিবেকানন্দের পিতা ভুপেন্দ্রনাথ রায়পুরে এটর্নি ছিলেন ।  স্থলপথে দূর-দূরান্তে যাওয়ার গোরুর গাড়ি ছাড়া আর উপায়ই বা কি ছিল ? সেকথা থাক । গোরুর গাড়ির কথা পরে বলা যাবে । ঘোড়ার কথা বলি ।

আধুনিক কোন শহরে যানবাহন বা পরিবহন ব্যবস্থার বিবর্তন বড় বিচিত্র, কলকাতার কথাই ধরা যাক । বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গতিময় জনবহুল শহর, কি ভাবে আজকের আধুনিক গতি পেল তা জানতে ইচ্ছে করে । কলকাতা প্রাচীন শহর নয় মোটেই । বয়স মাত্র তিনশ’বছর এবং কলকাতার বিকাশও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি । এদেশে বানিজ্য করতে আসা ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের বানিজ্যকুঠী বানানোর জন্য বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে সুতানূটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের জমিদারি সত্ব কিনেছিল । সেই তিনটি গ্রাম মিলেই কলকাতা । এসব কথা স্কুল-কলেজের পাঠ্য ইতিহাসে লেখা আছে, সেটা আমার বলার কথা নয় । একটা শহরের বিকাশ ও আধুনিকতার মাপকাঠি তার জনবিন্যাস, শিক্ষা ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বানিজ্য । ইংরেজ কোম্পানী তিনটি গ্রামের জমিদারি সত্ব কিনেছিল ১৬৯৮এর ১০ই নভেম্বর । ঐ দিনই সাবর্ণচৌধুরী ও কোম্পানীর মধ্যে বিক্রয় দলিল সই হয়েছিল ।

কলকাতার নগরায়ন শুরু হয়েছিল আরো পঞ্চাশ বছর পর থেকে, ১৭৫৭র পলাশীর যুদ্ধের পর, কেননা এরপরই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে তাদের দখলদারি পাকা করেছিল সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত ও হত্যা করে । তো এই নতুন ‘নগর কলকাতা’র পত্তনের সময়কার চেহারাটা একবার দেখে নেওয়া যাক । ১৭০৬ খৃষ্টাব্দে মুঘল আমলে কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানূটি গ্রামের জরীপের তথ্য অনুযায়ী এই তিনটি গ্রা্ম- যা নিয়ে ‘নগর কলকাতা’, তার মোট জমির পরিমান ছিল ৫০৭৬ বিঘা । যার মধ্যে ১৫২৫ বিঘা ছিল ধানক্ষেত, ৪৮৬বিঘায় বাগান, ২৫০বিঘায় কলাগাছ,১৮৭বিঘাতে তামাক চাষ ও ১৫০বিঘায় শাক-সজির চাষ । ১১৬বিঘাতে ছিল রাস্তা, খাল, পাতকূয়া ও পুকুর আর ১১৪৪ বিঘা ছিল পতিত । এই ছিল পত্তনের সময়কার ‘নগর কলকাতার’ চেহারা ।  তখন নগর কলকাতায় মাত্র দুটি ‘স্ট্রিট’ আর দুটি ‘লেন’, রোড বা চওড়া রাস্তা একটাও ছিলনা । রাস্তা নেই তো গাড়ি গড়াবে কি করে ? অগত্যা এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে বা এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় যাতায়াত করার উপায় ছিল শরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে পায়ে হাঁটা, কিংবা গোরুর গাড়ি নয়তো পালকি । এই দুটি যানই স্থলপথে যাতায়াতের জন্য আমাদের আদি গ্রামীণ বন্দোবস্ত । পালকি স্বচ্ছল লোকেদের পক্ষের ব্যবহার করা সম্ভব হ’ত । কলকাতার নগরায়ন শুরু হওয়ার পরও ‘পালকি’ সম্ভ্রান্ত ও অর্থবান বাঙ্গালিদের ও সাহেবদের কাছে ছিল খুব আদরের । এ ছিল আদি ‘নগর কলকাতা’র বাবু কালচারের অন্যতম প্রধান চিহ্ন । সওয়ারি হত দুজন, বইতো ৬জন বেহারা, মালপত্র বওয়ার জন্য কুলি আর রাতের পথে একজন মশালচি ।

সাহেবরা কলকাতা নগরীর পত্তন করলো মানে দ্রুত গতিতে সে এগিয়ে চললো এমন নয় মোটেই । পত্তনের পর আরো একশ বছর কলকাতার চেহারাটা প্রায় একই রকম ছিল । যাতায়াতের জন্য কয়েকটা শরু কাঁচা রাস্তায় গোরুর গাড়ি আর পালকি ভরসা । প্রথম বড় চওড়া খোয়া বাধান রাস্তা সার্কুলার রোড তৈরী হয়েছিল ১৭৯৮/৯৯ নাগাদ, ফলে তখন থেকেই ছুটতে লাগল দ্রুত গতির ঘোড়ায় টানা গাড়ি । আর ঘোড়া মানেই গতি, দ্রুত গতির প্রতীক । এরপর, আরো এখশ’ বছর ঘোড়ায় টানা গাড়িই ছিল নগর কলকাতার একমাত্র দ্রুতগতির যানবাহন । যাত্রীবাহী মোটর বাস কলকাতায় চলতে শুরু করেছিল ১৯২২ থেকে । তার আগে অবশ্য ট্যাক্সি চলা শুরু হয়েছে ১৯০৬ থেকে ।

ঘোড়ার গাড়ির চল হওয়া শুরু হতেই কলকাতার জনজীবনে গতি এলো । অনেক রাস্তা তৈরী হল । কলকাতার রাস্তা-ঘাট তৈরী করার জন্য ইংরেজরা একটা ‘লটারি কমিটি’ করেছিল, লটারির টাকায় শহরের নানান উন্নয়ন করা হ’ত । ওয়েলসলি সাহেব তখন গভর্ণর জেনারেল । ১৮৩৬ সালের মধ্যে কলকাতায় অনেক প্রধান রাস্তার নির্মাণ হয়ে গেল । স্ট্রান্ড রোড, কলেজ স্ট্রিট,আমহার্স্ট স্ট্রিট,মির্জাপুর স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট প্রভৃতি । ১৮৮৮ পর্যন্ত কলকাতার মোট রাস্তার পরিমান ছিল ১৮২ মাইল । ঐ বছরেই  ‘নগর কলকাতা’র আয়তন বাড়লো । এন্টালি, বেনেপুকুর, ট্যাংরা, তপসিয়া,বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, কালিঘাট, চেতলা, আলিপুর ও খিদিরপুর । নগর কলকাতার সেইসব রাস্তা এখনকার মত মসৃণ এসফল্ট বা পিচ বাঁধান ছিল না । ছিল খোয়া বাঁধান । কারণ ১৯১০এর আগে এসফল্ট বা বিটুমিন’এর ব্যবহার জানা ছিল না । ঐসব রাস্তা দিয়ে ছুটতো ঘোড়ার গাড়ি ।

 গাড়ি টানার কাজে ঘোড়াকে নানান উপায়ে ব্যবহার করা হত। উদ্দেশ্য দ্রুতগতিতে যাতায়াত । ব্রাউনলো নামে এক সাহেব বের করলেন ‘ব্রাউন বেরি’ নামে গাড়ি । সাবেকি পালকিতেই চারটি চাকা বসিয়ে সামনে ঘোড়া জুতে দিয়ে বানিয়ে ফেললো এক ঘোড়ায় টানা ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি, ১৮২৭এ  । ব্রাউন বেরির ভাড়া ছিল প্রথম একঘন্টায় চোদ্দ আনা, পরের প্রতি ঘন্টায় আট আনা আর সারা দিনের জন্য নিলে চার টাকা । নানান ধরনের ঘোড়ার গাড়ি ছিল । সাহেবদের জন্য দামি গাড়ি , সাধারণ কর্মচারিদের জন্য আলাদা গাড়ি । নানান নামের এইসব ঘোড়ার গাড়ি । চেরট, ফিটন, ল্যান্ডো, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এইরকম । অনেক বড় বড় কোম্পানী হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি তৈরী করার জন্য । এক্কা গাড়ি, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এসব নামগুলো প্রবাদের মত হয়ে গেছে । বহু যুগ ধরে বাংলা বর্ণমালায় পড়া “এক্কা গাড়ি ঐ ছুটেছে, ঐ দেখো ভাই চাঁদ উঠেছে”, বহুদিন অতীত হয়ে গেছে কলকাতার রাস্তা থেকে । তবু গোড়ার গাড়িই বোধয় কলকাতার সবচেয়ে ‘নস্টালজিক হেরিটেজ’ । এককালে কলকাতার ‘বাবু’রা ফিটনে চেপে ময়দানে হাওয়া খেতেন । আর সেই ঐতিহ্যের পথ বেয়ে এই সেদিনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে সারি দেওয়া ফিটন গাড়ি দেখা যেত ময়দানে শখের হাওয়া-ভ্রমণের জন্য । ২৬শে মার্চ ২০১২ থেকে তাদেরও বিদায় করা হয়ে গেছে ।

ইতিমধ্যে ১৮৫৪ সালের অগষ্ট মাস থেকে হাওড়া স্টেশন থেকে হুগলী পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে গেছে । কিন্তু কলকাতার ভেতরে একসঙ্গে বেশি পরিমান মালপত্র বইবার বা একসঙ্গে অনেক মানুষের যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা ছিলনা । সেই অসুবিধা দূর হল, ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু করে । মার্চ ১৮৭০ থেকে তোড়জোড় শুরু করে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বউবাজার, ডালহৌসি স্কোয়ার স্ট্রান্ড রোড হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত পাতা হল ট্রাম লাইন আর ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ থেকে ঘোড়ায় টানা ট্রাম গাড়ি চলা শুরু করলো । দুটো বলিষ্ঠ ঘোড়া দিয়ে চালানো হত ট্রাম । এরপর অনেক রাস্তায় ট্রাম লাইন পাতা হল, কলকাতা ট্রামওয়েস কোম্পানী গঠন হল । ঘোড়ায় টানা ট্রামই হয়ে উঠলো কলকাতার প্রথম গণপরিবহন ব্যবস্থা । ১৮৯০-৯১ সনে কলকাতায় ট্রাম টানবার জন্য ঘোড়ার সংখ্যা ছিল একহাজার, সবই শীতপ্রধান দেশ থেকে নিয়ে আসা বেশ বলবান ঘোড়া । প্রায় ত্রিশ বছর চালু ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রামের ব্যবস্থা । ঘোড়ায় টানা ট্রামের যুগ শেষ হল ১৯০২এ পৌছে । ২৭শে মার্চ ১৯০২ এ প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চলতে শুরু করলো ধর্মতলা – খিদিরপুর পথে । তার আগে কিছুদিন পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি পথে বাষ্পীয় ইঞ্জিন দিয়ে ট্রাম চালানো হয়েছিল । এখন  তো কলকাতার  কয়েকটা মাত্র পথে ট্রাম চলে  ।

১৮৮৬ সনে জার্মানীতে মোটরগাড়ি আবিষ্কার হওয়ার পর দশ বছরের মধ্যেই কলকাতার রাস্তায় মোটর গাড়ি দেখা দিল, আর তার দশবছর পরে ১৮৯৬এ কলকাতায় চলে এলো ট্যাক্সি । ১৯৪০/৪৫ সাল নাগাদ কলকাতায় ট্যাক্সির ভাড়া ছিল কমপক্ষে আট আনা, তারপর প্রত্যেক ১/৪ মাইলের জন্য দু’আনা । তখন যাতায়াতের জন্য কলকাতায় প্রধান উপায় ছিল ট্রাম । কিন্তু শহরের বাইরে, দূরে যাওয়ার সমস্যা ছিল, কারণ ট্যাক্সিতে খরচ বেশি । অবশেষে ১৯২২ সনে কলকাতায় চালু হয়ে গেল যাত্রীবাহী মোটর বাস ।  এর অনেক আগে - মোটর গাড়ি আবিষ্কারই হয়নি, তখন কিছু দিনের জন্য ঘোড়ায় টানা বাস চলার কথা জানা যায় । ধর্মতলা থেকে বারাকপুর পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা বাস চলেছিল ১৮৩০ সনে । কতদিন চলেছিল – এসব তথ্য জানা যায় না । ১৯২২ থেকে মোটর বাসই হয়ে গেল কলকাতার প্রধান গণ পরিবহন ব্যবস্থা । চালু হওয়ার সময় ১৯২৪এ কলকাতায় বাসের সংখ্যা ছিল ৫৫টি । সেই সংখ্যাটা ১৯২৫ সনে হয় ২৮০ । ১৯২৬এ চালু হয় দোতলা বাস । প্রথম দোতলা বাস চলেছিল শ্যামবাজার থেকে কালিঘাট । প্রথম চালু হওয়া দোতলা বাসগুলি বছর কুড়ি আগে দেখা বা ছবিতে দেখা বাসের মত ছিল না । বাসগুলির ওপরে ছাদ বা ছাউনি থাকতোনা । বর্ষায় যাত্রীরা ছাতা মাথায় বসে থাকতেন । ৮০রদশক পর্যন্তও বেশ কিছু প্রধান রাস্তায় দোতলা বাস চলতো । তারপর ১৯৯০ থেকে সেই সময়ের সরকার দোতলা বাস চালান বন্ধ করে দেয় । এখনও অনেকেই দোতলা বাসে চড়ার স্মৃতি রোমন্থন করে তৃপ্তি লাভ করেন । এখন নানা চেহারায় এই যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা – বাস, মিনিবাস, অটো ইত্যাদি । ১৯৪৮ থেকে সরকারী বাস চলাচল ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, গঠিত হয় স্টেট ট্রানসপোর্ট কর্পোরেশন । এখন অবশ্য সরকারি বাস সামান্যই চলে । ১৯৭৫এ চালু হয় ‘মিনিবাস’ । সেই সময় যারা মিনিবাসে চড়তেন তাদের মনে পড়বে, সেগুলির উচ্চতা বেশ কম ছিল, যার জন্য সাধারণ উচ্চতার যাত্রিকেও দাঁড়িয়ে যেতে হলে সারাক্ষণ ব্যথা সহ্য করেও বাসের মধ্যে ঘাড় নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো । এই গণ পরিবহন  ব্যবস্থার বয়স আপাতত অতয়েব একশ’ বছরেরও কম । 


কলকাতা বড় বিচিত্র শহর । এই জেটগতির যুগে দ্রুতগতির আধুনিক পরিবহন বন্দোবস্তের পাশাপাশিই মানুষ টানা রিকশর সহাবস্থান । ২০০৬এ পশ্চিমবঙ্গ সরকার টানা রিকশর চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল । তারপর ধীরে ধীরে কলকাতা থেকে এই ঔপনিবেশিক চিহ্নটি বিদায় নেয় । রিকশ'র জন্ম জাপানে, ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে । জাপানী ভাষায় এ গাড়িকে বলা হত জিন-রি-কি-শ , মানে 'মানুষ টানা গাড়ি' । ভারতে প্রথম বলা হত 'জিন রিকশ' । সেটা ছোট হয়ে 'রিকশ' হয়েছে । সিমলা তে এই গাড়ি প্রথম দেখা যায় ১৮৮০তে। লেডি ডাফরিনের আত্মকথায় আছে । কলকাতায় চিনারা প্রথম নিজেদের ব্যবহারের জন্য রিকশ'র প্রচলন করে ১৯০০/১৯০১ সন নাগাদ । তারপর চিনারা, ভাড়ায় রিকশ' চালানো শুরু করে ১৯১৩/১৪ থেকে । ভারতীয়রা রিকশর ব্যবসা শুরু করে ১৯২০ থেকে । ইংরেজ আমলে টানা রিকশ'র ভাড়া ছিল এক মাইল পর্যন্ত - তিন আনা । তার পরের প্রতি মাইলের জন্য তিন আনা। সময়ের হিসাবে একঘন্টার জন্য ছ আনা । এটা দুজনের বসার হিসাব। একজন হলে দেড় আনা প্রতি মাইল , একঘন্টার জন্য তিন আনা ।

স্বল্প দূরতের পথে যাতায়াতের জন্য তিন চাকার সাইকেল রিকশ এখনও মানুষের পরিহার্য বাহন । কলকাতার রাস্তায় সাইকেল রিকশ চালু হয়েছিল ১৯৪০ নাগাদ । তার পঞ্চাশ বছর আগেই অবশ্য দুই চাকার ব্যক্তিগত বাহন বাই-সাইকেল প্রচলিত হয়েছিল ১৮৮৯ সালে ।

মানুষ ও মালপত্রের বহন ছাড়াও চিঠিপত্র বা ডাক দূর দূরান্তে পৌছে দেবার কিরকম বন্দোবস্ত ছিল এবার সেটাও দেখি । পাঠ্য ইতিহাসে পড়েছি শের শাহ ঘোড়ার মাধ্যমে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন । তখন মানুষ ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বা ডাকের ব্যবহারই জানতো না । ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকালে ডাকব্যবস্থা গড়ে ওঠে । দূর-দূরান্তে, অন্য প্রদেশে ডাক নিয়ে যাবার জন্য মানুষ বওয়ার মত একই রকম ব্যবস্থা ছিল অর্থাৎ পালকি, গোরুর গাড়ি ও ঘোড়ায় টানা পালকি গাড়ি ।
এখন, এই একুশ শতকে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা কোন উচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছে তা আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় দেখছি । সে প্রসঙ্গ আমার বিষয় নয় । আমি শুধু কলকাতার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার আদিপর্বের কিছু তথ্য তুলে এনেছি আর তার বিবর্তনটা বুঝতে চেয়েছি । সর্ব দেশেই সভ্যতার অগ্রগতির ধাপগুলো একই – পেশী শক্তি,পশুশক্তি এবং তারপর যন্ত্রশক্তি । আর এই সবের নিয়ন্ত্রক অবশ্যই মানুষের মস্তিষ্ক । সুতরাং সেই একই ধারায় নগর কলকাতার সড়ক পরিবন ব্যবস্থা নানান ধাপ পেরিয়ে আজকের জেট-গতি যুগে এসেছে । আমি সেই ধাপগুলি ছুঁয়ে যেতে চেয়েছি ।
তথ্যসূত্র -

(১) কলিকাতা দর্পণ / রথীন্দ্রনাথ মিত্র,(২) কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত / বিনয় ঘোষ (৩) সংবাদপত্রে সেকালের কথা / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়



Tuesday, September 22, 2015

কথা কলকাতা - ছয়

কথা কলকাতা - ৬

যে শহর ছাপাখানা, সংবাদপত্র আর বইএর নাগাল পেয়েছে তাকে কে আর ধরে রাখবে ? কলকাতা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললো । নতুন যুগে নতুন মহানগরে যুগমানসের অভিব্যক্তি লিখে রাখছে ইতিহাস । বিজ্ঞান,ব্যক্তি স্বাধীনতা,সংস্কারমুক্তি, গণতন্ত্র ও শিক্ষার নূতন ভাবাদর্শে উদবুদ্ধ কলকাতা । শুরু হয়েছে নানান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড । নবযুগের বাংলার নবজাগৃতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠলো নগর কলকাতা । ১৮৩০ সালের মধ্যে কলকাতাতে ১১ট ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হল । ১৮৪৬ থেকে ১৮৫০এর মধ্যে লন্ডনের ৯টিব্যাঙ্কের শাখা এবং ভারতের অন্য প্রদেশের ৭টি ব্যাঙ্কের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল । কলকাতা অতয়েব ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে গেল । ১৮৫৭তেস্থাপিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ।

কলকাতার রাস্তাঘাটের শ্রীবৃদ্ধি কিন্তু এর অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক প্রাধান্যের সঙ্গে তাল রেখে হয়নি । আগে লটারির টাকা থেকে রাস্তাঘাটের নির্মাণ হত । ১৮৩৬এ লটারি কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয় ও স্থির হয় প্রতিবছর ২৫হাজার টাকা খরচ করা হবে রাস্তাঘাট তৈরী করার জন্য । ১৮৬৩ থেকে ১৮৮০ সনেরমধ্যে তৈরী হল ফ্রীস্কুল স্ট্রীট থেকে ধর্মতলা স্ট্রীট (১৮৬৪), ক্যানিং স্ট্রীট(১৮৬৫), বিডন স্ট্রীট (১৮৬৮), গ্রে স্ট্রীট (১৮৭৩) । ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত কলকাতায় মোট রাস্তার পরিমান ছিল ১৮১ মাইল,তারমধ্যে ৩৪মাইল ছিল খোলা নর্দমা বুজিয়ে করা সরু গলি । ১৮৮৮তে এন্টালি, বেনেপুকুর,ট্যাংরা, তপসিয়া, বালিগঞ্জ, খিদিরপুর,ভবানীপুর, কালিঘাট, চেতলা ও আলিপুরঅঞ্চলগুলিকে কলকাতার অন্তর্ভুক্ত করা হয় । সেই সময় ল্যান্সডাউন রোড, হরিশ মুখার্জী রোড, হাজরা মোড়, আপারসার্কুলার রোড,কালিটেম্পল রোড, গোপালনগর রোড প্রভৃতি রাস্তাগুলি তৈরী হয় ।

১৮৫৪র ১৫ই অগস্ট হাওড়া থেকে হুগলী প্রথম রেলগাড়ি চললো । সেই প্রথম ট্রেন সকাল সাড়ে আটটায় হাওড়া ছেড়ে হুগলী পৌছায় সকাল ১০টা১মিনিটে । অর্থাৎ হাওড়া থেকে হুগলী এই ২৪ মেইল রেলপথে সময় লেগেছিল ১ঘন্টা ৩১ মিনিট। রেল গাড়ি চলছে, সে এক অবাক করা কান্ড যেন ! তিন হাজারেরও বেশি লোক প্রথম দিনেররেলে চড়ার জন্য লাইন দিয়েছিাইল! তুলনায় অল্প কিছু লোককেই যায়গা দেওয়া গিয়েছিল । তখন হাওড়াতে নয়, টিকিটঘর ছিল আর্মেনিয়ান ঘাটে সেখান থেকে টিকিট কেটে স্টীমারে করেহাওড়া গিয়ে ট্রেনে চাপতে হত ।  রেল চালুহওয়ার  ষোল সপ্তাহ পরে যাত্রী পরিবহনেরএকটা হিসাব করা হয়েছিল । সেই হিসাব অনুযায়ী প্রথম ১৬ সপ্তাহে রেলে যাত্রী পরিবহনহয়েছিল - প্রথম শ্রেনীতে ৫৫১১ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২১,০০৫ এবং তৃতীয় শ্রেণীতে ৮৩,১১৮জনযাত্রী । ১৮৫৪তে প্রথম রেল চলার ৮বছরের মধ্যেই ১৮৬২তে আটঘন্টা কাজের দাবিতে হাওড়া স্টেশনে রেলের ১২০০ মজুর ধর্মঘট করে । সেটাই ছিল ভারতের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট ।
কলকাতার ভেতরে একস্থান থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য ছিল সেই ঘোড়ায়  টানা ছ্যাকরা গাড়ি আর পালকি । গোরুর গাড়ি করেও দূর দূরান্তে যেতে হতো । ১৮৭৮ সনের অগস্ট মাসে তখনও বেঙ্গল-নাগপুর রেললাইন হয়নি । ভাষাবিদ হরিনাথ দের মাতা এবং বিবেকানন্দের মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী শিশু হরিনাথ ও বালক বিবেকানন্দকে নিয়ে আড়িয়াদহ গ্রাম থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে গিয়েছিলেন গোরুর গাড়িতে করে ।

১৫ই নভেম্বর ১৮৬২ থেকে শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়াপর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয় । প্রথমে শিয়ালদহ স্টেশন বলতে একটা টিনের চালের ঘর ছিল। বড় আকারে শিয়ালদহ মেন স্টেশন তৈরী হয় ১৮৬৯ সনে ।

কলকাতা থেকে দূরে যাবার জন্য ছিল নদীপথ । কলকাতার আসেপাশের খালপথ দিয়ে নৌকা বোঝাই করে মালপত্র আসতো পূর্ববঙ্গ থেকে । দূরদূরান্তে ভ্রমণের জন্যও ছিল নদীপথ । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে বর্নণা আছে যে, ১৮৫৬ সনে দেবেন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে কাশি (বেনারশ) গিয়েছিলেন নৌকা করে । সময় লেগেছিল দেড়মাস আর নৌকা ভাড়া লেগেছিল ১০০টাকা ।

ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩এর আগে কলকাতায় দ্রুতগতির মাল ও যাত্রীবহন গাড়ি বলতে ছিল ঘোড়ায় টানা গাড়ি । নানা ধরনের গাড়ি তৈরী হত । চ্যারিয়ট,ফিটন,ব্রাউনবেরি,বগি গাড়ি এইসব, আর দেশীয় লোকেদের জন্য ছ্যাকরা গাড়ি । ২৪শেফেব্রুয়ারি ১৮৭৩এ কলকাতায়  প্রথম ট্রাম চালু হয় শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত, ঘোড়ায় টানা দুই কামরার ট্রাম ।আর্মেনিয়ান ঘাটে রেলের টিকিটঘর ছিল । সেখান থেকে স্টিমারে হাওড়া স্টেশন যেতে হত । ১৮৯০-৯১ সনে ট্রাম কোম্পানীর কর্মচারী সংখ্যা ছিল ২২৫০ আর ঘোড়ার সংখ্যা ছিল ১০০০ । বিদ্যুৎ শক্তি চালিত ট্রাম আসে অনেক পরে ১৯০২এর ১৪ই জুলাই থেকে এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর । ভাড়া ছিল প্রথম শ্রেণীতে দু আনা বা এখনকার১২পয়সা । 

১৮৭২এ কলকাতা বিনোদনের নতুন বন্দোবস্ত থিয়েটার পেয়ে গেল । চিৎপুরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি মধুসূদন সান্যালের বাড়ির উঠনে ন্যাশানাল থিয়েটার নাম দিয়ে তৈরী হলদেশের প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় । ৬ই ডিসেম্বর ১৮৭২ দীনবন্ধু মিত্রর নীলদর্পণনাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করল বাঙ্গালীর থিয়েটার ।

কলকাতায় দু চাকার সাইকেল এল ১৮৮৯ । কলকাতায় দু চাকার সাইকেলের আদি প্রবর্তক ছিলেন হেমেন্দ্রমোহন ঘোষ, হ্যারিসন রোডে প্রথম সাইকেলের দোকান খোলেন । তিনি তিনজন বিখ্যাত মানুষ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু,আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও ডাক্তার নীলরতন সরকারকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলেন ।
১৮৬৮তে কলকাতায় বড় পোষ্ট অফিস হ, জিপিও । ১৮৬৪তে শুরু হয়েছিল, তৈরী হতে সময় লেগেছিল চার বছর । এখানেই আগে পুরাতন কেল্লা ছিল।

কলকাতা তখনও বিদ্যুতের আলো দেখেনি । বিদ্যুতের আলো সম্পর্কে কলকাতা জানলো ১৮৭৯এ । ১৮৮৫তে দে শীল এন্ড কোম্পানীচিৎপুরে এক ধণাঢ্য লোকের বিয়ের শোভাযাত্রায় আলোর ব্যবস্থা করেছিল । ১৮৮৬তে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনেও বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা হয়েছিল । কিন্তু ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছিল অনেক পরে । ১৮৯৫তে সরকার আইন পাশ করে কলকাতার ৫.৬৪  বর্গমাইল এলাকায় বিদ্যুতসরবরাহের লাইসেন্স দেয় লন্ডনের ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর কলকাতার এজেন্টকে এটাই পরে হয়ক্যালকাটা ইলেট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন। ১৮৯৯এর এপ্রিল মাসে প্রিনসেপ ঘাটে তারা প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরী করে । প্রথম রাস্তার আলো জ্বলে হ্যারিশন রোড ওজগদীশচন্দ্র বোস রোডএ । বিদ্যুতের আলো এল বটে, কিন্তু খুব বেশি গ্রাহক আকর্ষিত হলনা ইউনিট পিছু দাম অত্যধিক বেশি হওয়ার কারণে । ১৯০১এর মধ্যে মাত্র ৭০৮টি বাড়িবিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছিল । ইউনিট পিছু দাম ছিল আট আনা । গ্রাহক কম হওয়ার কারণে পরে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দিয়েছিল ।

এইভাবে, ইটভাঙ্গা খোয়ার রাস্তা, ছ্যাকরা গাড়ি,গোরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা ট্রাম আর গ্যাসের আলো নিয়ে কলকাতা পা দিল বিশ শতকে । বিশশতকের গোড়াতেই কলকাতা পেলো কলের গান বা গ্রামফোন । দমদেওয়া যন্ত্রে একটা কালো গালার চাকতিতে রেকর্ড করা গান সেই যন্ত্রে লাগান একটা চোঙ্গার মধ্যদিয়ে শোনারব্যবস্থা । প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড করেছিল থিয়েটারের দুই নাচবালিকা শশিমুখী ও ফণিবালা ১৯০২ সনে । একই সময়ে ঘোড়ায় টানা ট্রামের যুগ শেষ হয়ে বিদ্যুত শক্তিতেট্রাম চালানো শুরু হল । ২৭শে মার্চ তারিখে প্রথম এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হল ।

১৯১১তে বঙ্গ ভঙ্গ প্রস্তাব রদ হল বটে, কিন্তু কলকাতাআর বৃটিশ ভারতের রাজধানী থাকলো না । ১৯১২তে গঠিত হল ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট’, তারা নগরায়নের কিছু বন্দোবস্ত করলো । এরা প্রথম যে রাস্তাটি বানিয়েছিলসেটি সেন্ট্রাল এভিনিঊ - ১৯২৬ থেকে যার নামহয় চিত্তরঞ্জন এভিনিউ । উত্তর কলকাতার রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট, বিবেকানন্দ রোড , গ্রে স্ট্রীট, রাসবিহারী এভিনিউ এই সময়কালেই নির্মিত । ১৯২৪ থেকেই কলকাতার খোয়ার রাস্তাগুলো এসফল্ট,পীচদিয়ে পাকা করার কাজ শুরু হয় । তার আগে এসফল্টের ব্যবহার কলকাতার জানা ছিল না ।১৯৪৩এর ৩রা ফেব্রুয়ারি৮২ফিট উঁচু আর ১৫০০ফিট লম্বা নতুন হাওড়া ব্রীজ খুলে গেল । 

বাসেরচেয়েও আগে এসেছিল ট্যাক্সি । কলকাতার রাস্তায় প্রথম ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো ১৯০৬থেকে । অনেকদিন পর্যন্ত প্রায় ১৯৪০-৪৫ পর্যন্ত ট্যাক্সির ভাড়া ছিল কমপক্ষে আট আনাতারপর সিকি মাইলের জন্য দু আনা । কলকাতায় যাত্রীবাহী বাস চালু হল ১৯২২এ । ১৯২৪এ কলকাতায় বাসের সংখ্যা ছিল ৫৫টি আর একবছর পরে ১৯২৫এ বেড়ে হয় ২৮০টি ।

গোরাউপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ তখনকার কলকতারকাব্যিক বর্ণনা দিয়েছিলেন এইভাবে – “শ্রাবণ মাসের সকালবেলা মেঘ কাটিয়া গিয়া নির্মলরৌদ্রে কলিকাতার আকাশ ভরিয়া গিয়াছে । রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বিরাম নাই,ফেরিওয়ালা অবিশ্রাম হাঁকিয়া চলিয়াছে,যাহারা আপিসে, কলেজে, আদালতে যাইবে তাহাদের জন্য বাসায়বাসায় মাছ-তরিকারির চুপড়ি আসিয়াছে ও রান্নাঘরে উনান জ্বালাইবার ধোঁয়া উঠিয়াছে কিন্তু তবু এত বড় এই যে কাজের শহর কঠিন হৃদয় কলিকাতা, ইহার শতশত রাস্তা এবং গলিরভিতর সোনার আলোকের ধারা আজ যেন একটা অপূর্ব প্রবাহ বহিয়া লইয়া চলিয়াছে

এইভাবে প্রাণের অপরূপ প্রবাহ নিয়ে নগর কলকাতা পৌছে গেল ১৯৪৭এর ১৫ই আগস্টে । সঙ্গে নিয়ে এলো তেতাল্লিশের মনুষ্য সৃষ্ট মন্বন্তর, ভাতৃঘাতি দাঙ্গার স্মৃতি, উদবাস্তু স্রোত আর দেশভাগের সুতীব্র ক্ষত ।
কথা কলকাতা আপাতত শেষ । এ শুধু ইট-কাঠের কলকাতার বেড়ে ওঠার কিছু বিবরণ । পরবর্তী পর্যায়ে কলকাতার মানুষ-সমাজ-সংগ্রাম আর রাজনীতি,যা কলকাতার অহংকার কলকাতার অলংকার ।

তথ্যসূত্র - বাংলার নবজাগৃতি / বিনয় ঘোষ, কলিকাতা দর্পণ / রথীন মিত্র , সংবাদপত্রে সেকালের কথা / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়