পাঠকের পছন্দ

Tuesday, September 22, 2015

কথা কলকাতা - তিন

কথা কলকাতা – ৩

কলকাতায় গড়ে উঠলো এক বেলাগাম দূর্নীতি আর বেলেল্লাপনার, মূল্যবোধহীন এক বিচিত্র সমাজ । অন্ধকারের উৎস থেকেই আলোক রেখার উতসার, আমরা জানি । ১৭৮০র জানুয়ারিতে জেমস অগস্টাস হিকি কলকাতায় একটা ছাপাখানা বসালেন আর ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে চার পৃষ্ঠার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করলেন । সেটিই দেশের প্রথম সংবাদ পত্র । হিকির পত্রিকায় হেস্টিংস ও কোম্পানীর কর্মচারীদের নানান দূর্নীতি ও কূকর্মের সংবাদ প্রকাশ হতে থাকল । হেস্টিংস হিকিকে জেলে ভরলেন, দুবছর চলার পর হিকির বেঙ্গল গেজেট বন্ধ হয়ে গেল । হিকির পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও, প্রায় একই সময়ে ইন্ডিয়া গেজেট, ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পমুখ পত্রিকার প্রকাশনা কলকাতার সমাজে এক নতুন মাত্রা যোগ করলো ।  

হেসটিংস জমানার হাজার দূর্নীতি ও কূকীর্তির মধ্যেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়েছিল । তখনকার কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি উইলিয়াম জোনসের উদ্যগে প্রাচ্য জ্ঞান-বিদ্যা চর্চা কেন্দ্র – ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠা ১৭৮৪তে আর সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের সাহায্য নিয়ে হলহেড সাহেবের লেখা ইংরাজি ভাষায় বাংলা ব্যকরণ রচনা ‘এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ । এই বইতেই প্রথম বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হল । বাংলা হরফ কেটে দিয়েছিলেন পঞ্চানন কর্মকার । তাঁকেই বাংলা হরফের জনক বলা হয় ।

ছাপাখানার বিস্তারের সঙ্গে আমাদের মানসিক বিকাশের সম্পর্ক গভীর ভাবে জড়িত, তাই এদেশে ছাপাখানা আসার ও বিস্তারের কাহিনিটা সংক্ষেপে বলে রাখি । জার্মানিতে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রন যন্ত্র প্রবর্তন (আবিষ্কার) করেন ১৪৫০এ । ভারতে পর্তুগীজরা ১৫৫৬ সনে, যে বছর আকবর মুঘল বাদশাহ হলেন, সেই বছর‌ গোয়াতে ছাপাখানা নিয়ে আসে ক্যাথলিক খৃষ্টানি বই ছাপার জন্য  । ভারতীয় ভাষায় সবচেয়ে পুরাতন ছাপার নমুনা পাওয়া গেছে কেরলে, তামিল ভাষায় অনুদিত খৃষ্টান ধর্ম বিষয়ক । ইংরেজরা এদেশে প্রথম ছাপাখানা বসায় এর দুশো বছর পরে, ১৭৭২এ মাদ্রাজে, আর বাংলায় হুগলীতে এন্ড্রুজ নামে এক সাহেব ছাপাখানা বসায় ১৭৭৮এ । এখান থেকেই হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অফ বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ ছাপানো হয় । পরের বছর ১৭৭৯এ হেসটিংসের আমলে কলকাতায় সরকারি ছাপাখানা বা ‘অফিসিয়াল প্রিন্টিং প্রেস’ স্থাপিত হয় । ছাপাখানা এসে যাওয়া মানে সমজ চর্চা ও জ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়া । এ দেশ সম্পর্কে বিদেশের মানুষ নানান সংবাদ জানতে পারলো, এ দেশ সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেল, ইংরেজদের নানান কুকীর্তি, দূর্নীতি, যথেচ্ছাচারের কথাও লোকে বেশি করে জানতে পারল । ১৭৮৯তে ফরাসি বিপ্লবে স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ বিশ্বের শিক্ষিত মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলেছে, আর এদেশে তখন ইংরেজ তার শাসন বন্দোবস্তকে আরো কঠোর করতে চাইছে । অতয়েব সংবাদ পত্রের সমালোচনা বন্ধ করার নানান ফন্দিফিকির খুঁজছে তারা ।
১৭৯৩এ কর্নওয়ালিশ বড়লাট হয়ে এসে চালু করলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত । নির্দিষ্ট দিনে খাজনা না মেটানোয় অনেক বনেদি জমিদারি নিলামে চড়লো, তৈরি হল ভুমি সম্পর্কহীন নতুন মধ্যশ্রেনী ইংরেজ শাসনের সহযোগী রূপে । কলকাতার জনসংখ্যা বাড়ল । ১৭৯৪এ কলকাতার রাস্তাগুলো ইটের খোয়া দিয়ে পাকা করার ব্যবস্থা হল কারণ, গাড়ি ঘোড়ার সংখ্যা বেড়েছে ইতিমধ্যে । গাড়ি বলতে পালকি আর ঘোড়ার গাড়ি । বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ঘোড়ার গাড়ি কেনেন নবকৃষ্ণ দেব । একটা পালকি টানতে লাগত পাঁচজন পালকিবাহক । ১৭৯০-৯৫এদের সারাদিনের মজুরি চিল পাঁচজনে মিলে একটাকা । একদিকে ইংরজ কর্মচারীদের আর তাদের দোসর এদেশীয় ‘বাবু’দের সীমাহীন বিলাস বৈভব অন্যদিকে সাধারণ শ্রমজীবিদের অসীম দারিদ্র !

ইউরোপীয় সাহেবরা তখন দু একজন বাংলা শিখছে অল্পবিস্তর । একজন রুশ পর্যটক গোলকনাথ দাস নামে একজনের কাছে বাংলা ভাষা শিখে বাংলা ভাষাতে একটা নাটক (প্রহসন) বাংলায় অনুবাদ করে ফেললেল ১৭৯৫এ এবং এখনকার এজরা স্ট্রীটের কাছে ডুমটোলায় অস্থায়ী মাচা বেঁধে এদেশীয় লোকেদের দিয়ে গনিকালয় থেকে মহিলা সংগ্রহ করে, ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করে নাট্যাভিনয়  করালেন । কলকাতা সেই প্রথম বাংলা নাটক দেখলো ।

১৭৯৮এ ওয়েলেসলি বড়লাট হয়ে এলেন । কলকাতায় ইংরেজ শাসন পোক্ত হলেও সারা ভারত তখনও তাদের তাঁবে আসেনি । দাক্ষিণাত্যে হায়দার আলি সঙ্গে যুদ্ধে ইংরাজ পর্যুদস্ত হয়েছিল । পরে হায়দারের পুত্র টিপু সুলতান ফরাসিদের সাহায্য নিয়েও পরাজিত ও নিহত হন । ওয়েলেসলি টিপুর নাবালক পুত্রকে নির্বাসিত করে কলকাতায় নিয়ে আসেন । সংবাদপত্রের সমালোচনা ওয়েলেসলির খুবই না-পসন্দ ছিল । তখন কলকাতা থেকে সাতটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হত । ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘মর্নিং পোষ্ট’, ‘টেলিগ্রাফ’, ‘ক্যালকাটা ক্যুরিয়র’, ‘ওরিয়েন্টাল ষ্টার’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট, ও ‘এশিয়াটিক মিরর’ । সবই ইংরাজদের মালিকানায় । বাংলা ভাষায় তখনও কোন সংবাদ পত্র প্রকাশ শুরু হয়নি, সেই মানসিকতাও গড়ে ওঠেনি তখনকার বাঙ্গালিদের মধ্যে । যুদ্ধ করে রাজ্য দখলের সমালোচনা প্রকাশ হচ্ছিল সংবাদপত্রগুলিতে । সরকারের সমালোচনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওয়েলেসলি জারি করল ‘সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ অর্ডিন্যান্স’। এদেশে সেই প্রথম সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ,  তাও এদেশে সংবাদপত্রের উদ্ভবের মাত্র কুড়িবছরের মধ্যেই ।
উনিশ শতকের শুরুতেই কলকাতার ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা শেখানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো ‘ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ’ ১৮০১এ ।
                                                                          ( চলবে ...)



No comments:

Post a Comment