পাঠকের পছন্দ

Tuesday, September 22, 2015

কথা কলকাতা - ছয়

কথা কলকাতা - ৬

যে শহর ছাপাখানা, সংবাদপত্র আর বইএর নাগাল পেয়েছে তাকে কে আর ধরে রাখবে ? কলকাতা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললো । নতুন যুগে নতুন মহানগরে যুগমানসের অভিব্যক্তি লিখে রাখছে ইতিহাস । বিজ্ঞান,ব্যক্তি স্বাধীনতা,সংস্কারমুক্তি, গণতন্ত্র ও শিক্ষার নূতন ভাবাদর্শে উদবুদ্ধ কলকাতা । শুরু হয়েছে নানান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড । নবযুগের বাংলার নবজাগৃতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠলো নগর কলকাতা । ১৮৩০ সালের মধ্যে কলকাতাতে ১১ট ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হল । ১৮৪৬ থেকে ১৮৫০এর মধ্যে লন্ডনের ৯টিব্যাঙ্কের শাখা এবং ভারতের অন্য প্রদেশের ৭টি ব্যাঙ্কের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল । কলকাতা অতয়েব ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে গেল । ১৮৫৭তেস্থাপিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ।

কলকাতার রাস্তাঘাটের শ্রীবৃদ্ধি কিন্তু এর অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক প্রাধান্যের সঙ্গে তাল রেখে হয়নি । আগে লটারির টাকা থেকে রাস্তাঘাটের নির্মাণ হত । ১৮৩৬এ লটারি কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয় ও স্থির হয় প্রতিবছর ২৫হাজার টাকা খরচ করা হবে রাস্তাঘাট তৈরী করার জন্য । ১৮৬৩ থেকে ১৮৮০ সনেরমধ্যে তৈরী হল ফ্রীস্কুল স্ট্রীট থেকে ধর্মতলা স্ট্রীট (১৮৬৪), ক্যানিং স্ট্রীট(১৮৬৫), বিডন স্ট্রীট (১৮৬৮), গ্রে স্ট্রীট (১৮৭৩) । ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত কলকাতায় মোট রাস্তার পরিমান ছিল ১৮১ মাইল,তারমধ্যে ৩৪মাইল ছিল খোলা নর্দমা বুজিয়ে করা সরু গলি । ১৮৮৮তে এন্টালি, বেনেপুকুর,ট্যাংরা, তপসিয়া, বালিগঞ্জ, খিদিরপুর,ভবানীপুর, কালিঘাট, চেতলা ও আলিপুরঅঞ্চলগুলিকে কলকাতার অন্তর্ভুক্ত করা হয় । সেই সময় ল্যান্সডাউন রোড, হরিশ মুখার্জী রোড, হাজরা মোড়, আপারসার্কুলার রোড,কালিটেম্পল রোড, গোপালনগর রোড প্রভৃতি রাস্তাগুলি তৈরী হয় ।

১৮৫৪র ১৫ই অগস্ট হাওড়া থেকে হুগলী প্রথম রেলগাড়ি চললো । সেই প্রথম ট্রেন সকাল সাড়ে আটটায় হাওড়া ছেড়ে হুগলী পৌছায় সকাল ১০টা১মিনিটে । অর্থাৎ হাওড়া থেকে হুগলী এই ২৪ মেইল রেলপথে সময় লেগেছিল ১ঘন্টা ৩১ মিনিট। রেল গাড়ি চলছে, সে এক অবাক করা কান্ড যেন ! তিন হাজারেরও বেশি লোক প্রথম দিনেররেলে চড়ার জন্য লাইন দিয়েছিাইল! তুলনায় অল্প কিছু লোককেই যায়গা দেওয়া গিয়েছিল । তখন হাওড়াতে নয়, টিকিটঘর ছিল আর্মেনিয়ান ঘাটে সেখান থেকে টিকিট কেটে স্টীমারে করেহাওড়া গিয়ে ট্রেনে চাপতে হত ।  রেল চালুহওয়ার  ষোল সপ্তাহ পরে যাত্রী পরিবহনেরএকটা হিসাব করা হয়েছিল । সেই হিসাব অনুযায়ী প্রথম ১৬ সপ্তাহে রেলে যাত্রী পরিবহনহয়েছিল - প্রথম শ্রেনীতে ৫৫১১ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২১,০০৫ এবং তৃতীয় শ্রেণীতে ৮৩,১১৮জনযাত্রী । ১৮৫৪তে প্রথম রেল চলার ৮বছরের মধ্যেই ১৮৬২তে আটঘন্টা কাজের দাবিতে হাওড়া স্টেশনে রেলের ১২০০ মজুর ধর্মঘট করে । সেটাই ছিল ভারতের প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট ।
কলকাতার ভেতরে একস্থান থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য ছিল সেই ঘোড়ায়  টানা ছ্যাকরা গাড়ি আর পালকি । গোরুর গাড়ি করেও দূর দূরান্তে যেতে হতো । ১৮৭৮ সনের অগস্ট মাসে তখনও বেঙ্গল-নাগপুর রেললাইন হয়নি । ভাষাবিদ হরিনাথ দের মাতা এবং বিবেকানন্দের মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী শিশু হরিনাথ ও বালক বিবেকানন্দকে নিয়ে আড়িয়াদহ গ্রাম থেকে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে গিয়েছিলেন গোরুর গাড়িতে করে ।

১৫ই নভেম্বর ১৮৬২ থেকে শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়াপর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয় । প্রথমে শিয়ালদহ স্টেশন বলতে একটা টিনের চালের ঘর ছিল। বড় আকারে শিয়ালদহ মেন স্টেশন তৈরী হয় ১৮৬৯ সনে ।

কলকাতা থেকে দূরে যাবার জন্য ছিল নদীপথ । কলকাতার আসেপাশের খালপথ দিয়ে নৌকা বোঝাই করে মালপত্র আসতো পূর্ববঙ্গ থেকে । দূরদূরান্তে ভ্রমণের জন্যও ছিল নদীপথ । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে বর্নণা আছে যে, ১৮৫৬ সনে দেবেন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে কাশি (বেনারশ) গিয়েছিলেন নৌকা করে । সময় লেগেছিল দেড়মাস আর নৌকা ভাড়া লেগেছিল ১০০টাকা ।

ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩এর আগে কলকাতায় দ্রুতগতির মাল ও যাত্রীবহন গাড়ি বলতে ছিল ঘোড়ায় টানা গাড়ি । নানা ধরনের গাড়ি তৈরী হত । চ্যারিয়ট,ফিটন,ব্রাউনবেরি,বগি গাড়ি এইসব, আর দেশীয় লোকেদের জন্য ছ্যাকরা গাড়ি । ২৪শেফেব্রুয়ারি ১৮৭৩এ কলকাতায়  প্রথম ট্রাম চালু হয় শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত, ঘোড়ায় টানা দুই কামরার ট্রাম ।আর্মেনিয়ান ঘাটে রেলের টিকিটঘর ছিল । সেখান থেকে স্টিমারে হাওড়া স্টেশন যেতে হত । ১৮৯০-৯১ সনে ট্রাম কোম্পানীর কর্মচারী সংখ্যা ছিল ২২৫০ আর ঘোড়ার সংখ্যা ছিল ১০০০ । বিদ্যুৎ শক্তি চালিত ট্রাম আসে অনেক পরে ১৯০২এর ১৪ই জুলাই থেকে এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর । ভাড়া ছিল প্রথম শ্রেণীতে দু আনা বা এখনকার১২পয়সা । 

১৮৭২এ কলকাতা বিনোদনের নতুন বন্দোবস্ত থিয়েটার পেয়ে গেল । চিৎপুরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি মধুসূদন সান্যালের বাড়ির উঠনে ন্যাশানাল থিয়েটার নাম দিয়ে তৈরী হলদেশের প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় । ৬ই ডিসেম্বর ১৮৭২ দীনবন্ধু মিত্রর নীলদর্পণনাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করল বাঙ্গালীর থিয়েটার ।

কলকাতায় দু চাকার সাইকেল এল ১৮৮৯ । কলকাতায় দু চাকার সাইকেলের আদি প্রবর্তক ছিলেন হেমেন্দ্রমোহন ঘোষ, হ্যারিসন রোডে প্রথম সাইকেলের দোকান খোলেন । তিনি তিনজন বিখ্যাত মানুষ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু,আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও ডাক্তার নীলরতন সরকারকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলেন ।
১৮৬৮তে কলকাতায় বড় পোষ্ট অফিস হ, জিপিও । ১৮৬৪তে শুরু হয়েছিল, তৈরী হতে সময় লেগেছিল চার বছর । এখানেই আগে পুরাতন কেল্লা ছিল।

কলকাতা তখনও বিদ্যুতের আলো দেখেনি । বিদ্যুতের আলো সম্পর্কে কলকাতা জানলো ১৮৭৯এ । ১৮৮৫তে দে শীল এন্ড কোম্পানীচিৎপুরে এক ধণাঢ্য লোকের বিয়ের শোভাযাত্রায় আলোর ব্যবস্থা করেছিল । ১৮৮৬তে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনেও বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা হয়েছিল । কিন্তু ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছিল অনেক পরে । ১৮৯৫তে সরকার আইন পাশ করে কলকাতার ৫.৬৪  বর্গমাইল এলাকায় বিদ্যুতসরবরাহের লাইসেন্স দেয় লন্ডনের ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর কলকাতার এজেন্টকে এটাই পরে হয়ক্যালকাটা ইলেট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন। ১৮৯৯এর এপ্রিল মাসে প্রিনসেপ ঘাটে তারা প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরী করে । প্রথম রাস্তার আলো জ্বলে হ্যারিশন রোড ওজগদীশচন্দ্র বোস রোডএ । বিদ্যুতের আলো এল বটে, কিন্তু খুব বেশি গ্রাহক আকর্ষিত হলনা ইউনিট পিছু দাম অত্যধিক বেশি হওয়ার কারণে । ১৯০১এর মধ্যে মাত্র ৭০৮টি বাড়িবিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছিল । ইউনিট পিছু দাম ছিল আট আনা । গ্রাহক কম হওয়ার কারণে পরে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দিয়েছিল ।

এইভাবে, ইটভাঙ্গা খোয়ার রাস্তা, ছ্যাকরা গাড়ি,গোরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা ট্রাম আর গ্যাসের আলো নিয়ে কলকাতা পা দিল বিশ শতকে । বিশশতকের গোড়াতেই কলকাতা পেলো কলের গান বা গ্রামফোন । দমদেওয়া যন্ত্রে একটা কালো গালার চাকতিতে রেকর্ড করা গান সেই যন্ত্রে লাগান একটা চোঙ্গার মধ্যদিয়ে শোনারব্যবস্থা । প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড করেছিল থিয়েটারের দুই নাচবালিকা শশিমুখী ও ফণিবালা ১৯০২ সনে । একই সময়ে ঘোড়ায় টানা ট্রামের যুগ শেষ হয়ে বিদ্যুত শক্তিতেট্রাম চালানো শুরু হল । ২৭শে মার্চ তারিখে প্রথম এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হল ।

১৯১১তে বঙ্গ ভঙ্গ প্রস্তাব রদ হল বটে, কিন্তু কলকাতাআর বৃটিশ ভারতের রাজধানী থাকলো না । ১৯১২তে গঠিত হল ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট’, তারা নগরায়নের কিছু বন্দোবস্ত করলো । এরা প্রথম যে রাস্তাটি বানিয়েছিলসেটি সেন্ট্রাল এভিনিঊ - ১৯২৬ থেকে যার নামহয় চিত্তরঞ্জন এভিনিউ । উত্তর কলকাতার রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট, বিবেকানন্দ রোড , গ্রে স্ট্রীট, রাসবিহারী এভিনিউ এই সময়কালেই নির্মিত । ১৯২৪ থেকেই কলকাতার খোয়ার রাস্তাগুলো এসফল্ট,পীচদিয়ে পাকা করার কাজ শুরু হয় । তার আগে এসফল্টের ব্যবহার কলকাতার জানা ছিল না ।১৯৪৩এর ৩রা ফেব্রুয়ারি৮২ফিট উঁচু আর ১৫০০ফিট লম্বা নতুন হাওড়া ব্রীজ খুলে গেল । 

বাসেরচেয়েও আগে এসেছিল ট্যাক্সি । কলকাতার রাস্তায় প্রথম ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো ১৯০৬থেকে । অনেকদিন পর্যন্ত প্রায় ১৯৪০-৪৫ পর্যন্ত ট্যাক্সির ভাড়া ছিল কমপক্ষে আট আনাতারপর সিকি মাইলের জন্য দু আনা । কলকাতায় যাত্রীবাহী বাস চালু হল ১৯২২এ । ১৯২৪এ কলকাতায় বাসের সংখ্যা ছিল ৫৫টি আর একবছর পরে ১৯২৫এ বেড়ে হয় ২৮০টি ।

গোরাউপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ তখনকার কলকতারকাব্যিক বর্ণনা দিয়েছিলেন এইভাবে – “শ্রাবণ মাসের সকালবেলা মেঘ কাটিয়া গিয়া নির্মলরৌদ্রে কলিকাতার আকাশ ভরিয়া গিয়াছে । রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বিরাম নাই,ফেরিওয়ালা অবিশ্রাম হাঁকিয়া চলিয়াছে,যাহারা আপিসে, কলেজে, আদালতে যাইবে তাহাদের জন্য বাসায়বাসায় মাছ-তরিকারির চুপড়ি আসিয়াছে ও রান্নাঘরে উনান জ্বালাইবার ধোঁয়া উঠিয়াছে কিন্তু তবু এত বড় এই যে কাজের শহর কঠিন হৃদয় কলিকাতা, ইহার শতশত রাস্তা এবং গলিরভিতর সোনার আলোকের ধারা আজ যেন একটা অপূর্ব প্রবাহ বহিয়া লইয়া চলিয়াছে

এইভাবে প্রাণের অপরূপ প্রবাহ নিয়ে নগর কলকাতা পৌছে গেল ১৯৪৭এর ১৫ই আগস্টে । সঙ্গে নিয়ে এলো তেতাল্লিশের মনুষ্য সৃষ্ট মন্বন্তর, ভাতৃঘাতি দাঙ্গার স্মৃতি, উদবাস্তু স্রোত আর দেশভাগের সুতীব্র ক্ষত ।
কথা কলকাতা আপাতত শেষ । এ শুধু ইট-কাঠের কলকাতার বেড়ে ওঠার কিছু বিবরণ । পরবর্তী পর্যায়ে কলকাতার মানুষ-সমাজ-সংগ্রাম আর রাজনীতি,যা কলকাতার অহংকার কলকাতার অলংকার ।

তথ্যসূত্র - বাংলার নবজাগৃতি / বিনয় ঘোষ, কলিকাতা দর্পণ / রথীন মিত্র , সংবাদপত্রে সেকালের কথা / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়


No comments:

Post a Comment